নির্বাচনী রোডম্যাপ : এবার আলোচনায় এপ্রিল
প্রকাশ : ১১-০৬-২০২৫ ১১:৩৮

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় রোডম্যাপ প্রকাশ করবে— এমন ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণাকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি ও ইসলামপন্থী দলগুলোর অবস্থান, প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফর এবং সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আসন্ন বৈঠক নিয়ে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ ও নতুন আশা।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পরপরই জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে নির্বাচনের সময়সূচিকে স্বাগত জানানো হয়। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জাতি আশ্বস্ত হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায়। আমরা আশা করি, ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরো বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন— এই তিনটি ভিত্তিকে সামনে রেখে এবং ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনকে ঘিরে নির্ধারিত সময়সূচি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও বিষয়টি নাকচও করেনি। দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসা দলটির মধ্যে এখন কিছুটা আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নির্বাচনের সময়সূচি কিছুটা এগিয়ে এনে ডিসেম্বর বা সর্বোচ্চ ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করার পক্ষে।
বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, তারা এখনো এপ্রিল মাসে নির্বাচনের উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটি নিয়ে তাদের চূড়ান্ত অবস্থান এখনও নির্ধারিত হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার ঠিক পরপরই নজর ঘুরে গেছে লন্ডনের দিকে। আগামী ১৩ জুন (শুক্রবার) লন্ডনের ডোরচেস্টার হোটেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ওই বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। ডোরচেস্টার হোটেলেই স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ফখরুল বলেন, বৈঠকটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিছক একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে সমঝোতার সম্ভাব্য প্রক্রিয়ার সূচনা।
তিনি আরো বলেন, তারেক রহমান রাজনৈতিকভাবে এই মুহূর্তে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। আমরা তাকে (তারেক রহমান) সম্পূর্ণ অথরিটি দিয়েছি। বৈঠকের সফলতা কামনা করছি। বৈঠকের পরপরই ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের ডেপুটি লিডার অব দ্য হাউসও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন। একই ভেন্যুতে অন্যান্য নেতারাও সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল মনে করছে, এপ্রিল মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা যৌক্তিক নয়। আবহাওয়ার চরম তাপমাত্রা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এবং ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা প্রশাসনিক প্রস্তুতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ ছাড়া, রমজান মাস মার্চের শেষভাগ থেকেই শুরু হওয়ায় নির্বাচনী প্রচারণা, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও কমিশনের প্রস্তুতিতে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
বিএনপিপন্থী বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকল্পনার অংশ। ডিসেম্বর-জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে নতুন সরকার মার্চ থেকে বাজেট পরিকল্পনায় মনোযোগ দিতে পারবে। এপ্রিল নির্বাচন হলে সরকার গঠনের পর হাতে সময় থাকবে মাত্র দুই মাস— যা দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও বাজেট কাঠামোতে প্রভাব ফেলতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও কিছু শর্ত আরোপ করেছে। দলটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আমরা নির্বাচনকালীন মৌলিক সংস্কার দেখতে চাই— বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই একটি সমান সুযোগের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ছোট দল হোক বা বড় দল, সবাই স্বচ্ছ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব চলছে। রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে অনেকটাই স্থিরতা এসেছে, তবে সময়সূচি নিয়ে এখনো দ্বিমত রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বিএনপি চাইছে ডিসেম্বর বা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হোক। অন্যদিকে, জামায়াত ও এনসিপি এপ্রিলের সময়সূচিকে সমর্থন করছে। তার মতে, এমন পরিস্থিতিতে ইউনূস-তারেক বৈঠক শুধুই কূটনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সমাধানের সন্ধান। যদি এই বৈঠক থেকে সময়সূচি পরিবর্তন, রাজনৈতিক সমঝোতা বা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে আসে, তবে সেটি হবে এক বড় অর্জন।
বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রশ্ন, নির্বাচনী সময়সূচির পরিবর্তন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে চূড়ান্ত অবস্থান এসব বিষয়েই সিদ্ধান্ত আসতে পারে এই আলোচনায়। এমনকি বিএনপির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গণতান্ত্রিক প্রত্যাবর্তনও এই বৈঠকের মাধ্যমেই সূচিত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, সরকারের সামনে প্রকৃত চ্যালেঞ্জই হবে নিজে নিরপেক্ষ থেকে একটি পক্ষপাতহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন তারা যে করতে চায়, সেই আস্থাটা অর্জন করা। ইতোমধ্যেই দু'একটি দলের প্রতি তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে। এর নিষ্পত্তি না হলে আইন শৃঙ্খলা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com