weather ২৫.৯৯ o সে. আদ্রতা ৯৪% , রবিবার, ১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আইন ও জরিমানার বিধান কাগজে-কলমে, জনস্বাস্থ্যে শঙ্কা

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস

প্রকাশ : ৩১-০৫-২০২৫ ১১:৫২

ছবি : সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে অসংক্রামক রোগসহ নানা ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতা থেকে শুরু করে বহু প্রাণঘাতী রোগের পেছনে রয়েছে তামাকের সরাসরি সংযোগ। তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন ও জরিমানার বিধান থাকলেও তার বাস্তব প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল, ফলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার (৩১ মে) পালিত হচ্ছে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন তামাকবিরোধী ও স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্তকরণের কথা; তা না হলে তামাকের আরো বিস্তার জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।

পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবতা তার বিপরীত। যেখানে-সেখানে মানুষ ধূমপান করছে, আর তা ঠেকাতে কার্যকর কোনো নজরদারি নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেখা যাচ্ছে গণপরিবহনে। হাসপাতাল, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গাতেই চলছে অবাধে ধূমপানের মহোৎসব। আইন অনুযায়ী, পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ধূমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানা, ধূমপানমুক্ত রাখতে না পারলে মালিককে ৫০০ টাকা এবং ‘ধূমপান নিষেধ’ সাইনবোর্ড না টাঙালে এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব আইন প্রয়োগের উদাহরণ খুবই কম।

ধূমপায়ী ব্যক্তি যেমন নিজের স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি তৈরি করছেন, তেমনি আশপাশের অধূমপায়ীরাও মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে নারী ও শিশুরাও ক্যানসার, হৃদরোগ, কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের সংস্পর্শে থাকা অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৮৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ধূমপানের কারণে যারা কখনো তামাক ব্যবহার করেননি, তাদের তুলনায় তামাক ব্যবহারকারীদের ফুসফুস ক্যানসার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি যথাক্রমে ৫৭ ও ১০৯ শতাংশ বেশি।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষ করে শহুরে রেস্টুরেন্টগুলোতে গড়ে উঠেছে ‘স্মোকিং জোন’, যেখানে বসে তরুণ-তরুণীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করছেন। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ই-সিগারেটের ব্যবহারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। নাটক, সিনেমা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এখন হরহামেশাই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ধূমপান করতে দেখা যায়; যা তরুণ সমাজকে ধূমপানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে।

ঢাকা আহছানিয়া মিশনের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর ৯১ শতাংশ গণপরিবহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করা হয়। ৪১৭টি বাস পরিদর্শন করে দেখা যায়, একটিতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় কোনো সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড নেই। এমনকি, ৯৯ শতাংশ বাসেই কোনো রকমের নিষেধাজ্ঞাসূচক চিহ্ন দেখা যায়নি। যাত্রী ও চালক-মালিকদের মাঝে আইন সম্পর্কে সচেতনতার চরম অভাব রয়েছে। জরিপে আরো উঠে এসেছে, ৮৯ শতাংশ বাস চালক ও সহকারী পরিবহন চলাকালীন ধূমপান করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ লাখ ৭২ হাজার মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যান। এর মধ্যে এক লাখ ৬১ হাজার জনের মৃত্যু সরাসরি তামাকজনিত রোগের কারণে হয়। অর্থাৎ, প্রতিদিন প্রায় ৪৪২ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন তামাক ব্যবহারের পরিণতিতে। গবেষণায় আরো উঠে এসেছে, তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর পঙ্গুত্ব বরণ করছেন প্রায় তিন লাখ ৮২ হাজার মানুষ।

বর্তমানে দেশে ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন, যার মধ্যে ২০ দশমিক ছয় শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক এবং ১৮ শতাংশ ধূমপায়ী। এ ছাড়া, ২৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গণপরিবহনে চলাচলের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। দেশে প্রায় তিন কোটি ৮৪ লাখ মানুষ নিয়মিত পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নয় দশমিক দুই শতাংশের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে।

তামাক চাষের কারণে দেশে ৩১ শতাংশ বন উজাড়ের ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, তামাক ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্য ব্যয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস ও মৃত্যুজনিত ক্ষতির সম্মিলিত পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৪৫টি জেলায় ৯৪৪টি স্থানে আট হাজার ১৯টি বিক্রয়কেন্দ্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটি) এবং ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তামাকপণ্যের করব্যবস্থা সংস্কার করা হলে সিগারেট ব্যবহার ১৫ দশমিক এক শতাংশ থেকে নেমে আসবে ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশে। এর ফলে প্রায় ২৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হবেন এবং প্রায় ১৭ লাখ তরুণ ধূমপান শুরু করা থেকে বিরত থাকবেন। এতে করে আট লাখ ৬৪ হাজার ৭৫৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং আট লাখ ৬৯ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকালমৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা— যা আগের বছরের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি।

তামাকবিরোধী সংগঠন ‘মানস’-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, দেশের নাটক-সিনেমা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ধূমপানের দৃশ্য নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। এতে দর্শক, বিশেষ করে তরুণ সমাজ প্রভাবিত হচ্ছে। তিনি বলেন, রেস্টুরেন্টে স্মোকিং কর্নার তৈরি করে তামাক কোম্পানিগুলো সচেতনভাবে তাদের পণ্য প্রচার করছে। বিক্রয় প্রতিনিধিদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে এসব কোম্পানি নানা কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এসব অপকৌশল বন্ধ করা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, প্রতিবছর প্রায় ১৪-১৫ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন এবং এতে করে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ছেন। তামাকজনিত রোগের কারণে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, মাথাপিছু আয় যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তামাক কর বাড়াতে হবে। জর্দা ও গুলের মতো অধূমপায়ী পণ্যে নজরদারির অভাব রয়েছে। করও সংগ্রহ করা হচ্ছে কম। তামাকপণ্য থেকে যে কর আহরণ করা হয়, জর্দা ও গুল থেকে আসে মাত্র শূন্য ১৪ শতাংশ। 

এটি দেখেই বোঝা যায় এমন সব পণ্য প্রাধান্য পাচ্ছে না। ফলে বাসা বাড়িতে এগুলো উৎপাদন হচ্ছে। সেই সঙ্গে ১০ গ্রাম জর্দা ৪৮ টাকায় ও গুল ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতো কম টাকায় এসব পণ্য মানা যায় না। এক্ষেত্রে কম্প্রিহেনসিভ ট্যাক্স পলিসি প্রয়োজন। কারণ এসব পণ্যের কর বাড়লে, মানুষ কম কিনবে। এতে কর আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে।

পিপলসনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --


CONTACT

ads@peoplenewsbd.com

শত কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন : খন্দকার মোশাররফের নামে দুদকের মামলা শত কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন : খন্দকার মোশাররফের নামে দুদকের মামলা সরকার নির্ধারিত হাসিলের বাইরে কোরবানি পশু বিক্রেতা ও ক্রেতার নিকট হতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না : ডিএমপি কমিশনার সরকার নির্ধারিত হাসিলের বাইরে কোরবানি পশু বিক্রেতা ও ক্রেতার নিকট হতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না : ডিএমপি কমিশনার সিলেট রেঞ্জে চালু হলো অনলাইন জিডি সিলেট রেঞ্জে চালু হলো অনলাইন জিডি নতুন ডিজাইনের তিন নোট বাজারে আসছে আজ নতুন ডিজাইনের তিন নোট বাজারে আসছে আজ নাইজেরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা, ২১ অ্যাথলেট নিহত নাইজেরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা, ২১ অ্যাথলেট নিহত