গত ১০ মাসে গ্রেপ্তার ৩ লাখ ৬০ হাজার, কারাগারগুলোতে চাপ
প্রকাশ : ০১-০৬-২০২৫ ১০:৩৯

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ মাসে সারাদেশে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের দৈনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয় এক লাখ ৪৬ হাজার ১০৯ জন, আর ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে দুই লাখ ১৩ হাজার ৬৮৯ জন।
গত জুলাইয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই পুলিশ প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ ঘটে। এর প্রভাবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম— আগস্টে ১৫ হাজার ৪৯২ ও সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৬০৭ জন। তবে পরিস্থিতি সামলে ওঠার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়।
কারাগার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সারাদেশে কারাগারের সংখ্যা ৬৯টি। এসব কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৮৭। আর বর্তমানে বন্দি আছে ৭৩ হাজার ছয় জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৭০ হাজার ৪১৭ এবং নারী দুই হাজার ৫৮৯ জন। এর বাইরে কিশোর সংশোধনাগারে কিছু বন্দি থাকে।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) জান্নাত-উল ফরহাদ বলেন, প্রতিদিন কারাগারে নতুন করে ঢোকা বন্দি এবং জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা সাধারণত কাছাকাছি থাকে। সর্বশেষ ২৯ মে দুই হাজার ৫৫৩ জন কারাগারগুলো থেকে জামিনে বের হয়েছেন। সেদিন এক হাজার ৮৩২ জন নতুন বন্দি কারাগারে ঢুকেছেন। তিনি বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকলেও তাদের স্থান সংকুলানে সমস্যা হচ্ছে না।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মে মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ২০৮ জন। গড়ে প্রতিদিন গ্রেপ্তার এক হাজার ৪৫৮। অবশ্য প্রথম পাঁচ মাসে প্রতিদিনের গড় গ্রেপ্তার ছিল ৯৭৪ জন। আর পরের পাঁচ মাসের দৈনিক গড় গ্রেপ্তার এক হাজার ৪২৪ জন। পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাবে, স্বাভাবিক সময়ে দেশে দৈনিক গড় গ্রেপ্তার এক হাজারের কাছাকাছি। মাসে ৩০ হাজারের মতো।
বর্তমানে বিশেষ কোনো নাম দিয়ে অভিযান না চললেও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ তৎপর। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার মব সৃষ্টি, হামলা-ভাঙচুর, দখল-চাঁদাবাজির প্রকাশ্য ও আলোচিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের তথ্য বেশ কম।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়। ২১ দিনে সারাদেশে ৩২ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ১২ হাজার ৫০০ জন। অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে ১৯ হাজার ৫৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গড়ে প্রতিদিন গ্রেপ্তার হয় এক হাজার ৫২৫ জন।
এই অভিযান চলাকালে প্রতিদিনের গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান জানাত পুলিশ সদরদপ্তর। সেখানে ডেভিল হান্ট ও অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হতো। পরে ডেভিল হান্ট নাম নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি তোলায় ওই নামে অভিযান বন্ধ করা হয়।
পুলিশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছরের শুরু থেকে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। জানুয়ারিতে সারাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০ হাজার ৪২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪১ হাজার ১৮১, মার্চে ৪৩ হাজার ৯২০ ও এপ্রিলে ৪৩ হাজার ৭৬৬ জন। এর আগে ২০২৪ সালের আগস্টে সারাদেশে গ্রেপ্তার ছিল ১৫ হাজার ৪৯২। সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৬০৭, অক্টোবরে ৩৫ হাজার ১৯২, নভেম্বরে ৪১ হাজার ৬৪ ও ডিসেম্বরে ৩৭ হাজার ৩২৬ জন।
পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশ এখন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই অভিযান ও গ্রেপ্তারে গতি এসেছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা কোথায় কী ধরনের ‘অ্যাক্টিভিটির’ সঙ্গে যুক্ত, তার ওপর বাড়তি নজর থাকছে। ঝটিকা মিছিল বের করার পর তারা ফেসবুকে পোস্ট করে। এর সূত্র ধরে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। সারাদেশ কেন, এক মোহাম্মদপুর এলাকা ১০ মাসে স্বাভাবিক করা যায়নি। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বড় বিষয় নয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিশৃঙ্খলা তৈরিসহ বিভিন্ন অপরাধে যারা যুক্ত, তারা ধরা পড়ছে কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমরা এখনও দেখছি, মব সৃষ্টি করে কারও কারও কাছ থেকে বৈধতা পাওয়া যাচ্ছে। যদি অভিযান বা গ্রেপ্তার শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে তা পরিস্থিতি উন্নতিতে কোনো কাজে আসে না।
সারাদেশের ৫৭টি কারাগার থেকে বন্দিদের তথ্য সংগ্রহ করেছ দেখা যায়, অধিকাংশ কারাগারের ধারণক্ষমতার বেশি বন্দি আছে। কোনো কোনো কারাগারের ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ-তিন গুণ বন্দি। ব্যতিক্রম শুধু দুটি কারাগার– সিলেট ও মেহেরপুর, যেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে কম বন্দি আছে। সিলেট কারাগারে ধারণক্ষমতা তিন হাজার ২৫৮। বন্দি আছেন দুই হাজার ২০। মেহেরপুরে ৩৫০ ধারণক্ষমতার বিপরীতে আছেন ২৮২ জন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার বলেন, কারাগারে বন্দি ধারণক্ষমতা চার হাজার ৫৯০ জন। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় গড়ে আট হাজারের মতো বন্দি থাকছেন। সর্বশেষ গত শনিবার এই সংখ্যা ছিল আট হাজার ২০০। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় এখানে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বন্দি ছিলেন। পরে তা বেড়ে যায়। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন নতুন বন্দি কারাগারে যুক্ত হন। প্রায় সমানসংখ্যক জামিনে মুক্ত হন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দির ধারণক্ষমতা দুই হাজার ২৪৯ জনের। এখন আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। প্রতিদিন গড়ে একশজনের জামিননামা আসে। আর নতুন বন্দি ঢোকে গড়ে একশর বেশি।
গত ১২ মে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান আরো জোরালো হয়। দলটির সাবেক সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার চলছে। এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ৮৭ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। শনিবার পর্যন্ত ধরলে মে মাসে গ্রপ্তার ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যেন মিছিল বা সভা-সমাবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
গত এক মাসে শুধু ঢাকাতেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত ২৩৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে সাবেক আট সংসদ সদস্য রয়েছেন। গত ১৬ মে বরিশাল-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ১৪ মে ময়মনসিংহ-১ (ভালুকা) আসনের সাবেক সাংসদ কাজিম উদ্দিন আহমেদ ধনু, ১২ মে মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সাংসদ শিল্পী মমতাজ বেগম, ১০ মে সুনামগঞ্জের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সাংসদ শামীমা আক্তার খানম ওরফে শামীমা শাহরিয়ার, ৯ মে কুমিল্লার সংরক্ষিত আসনের সাবেক সাংসদ সেলিনা ইসলাম, ৬ মে বাগেরহাট-৪ আসনের সাবেক সাংসদ আমিরুল আলম মিলন, ২৭ এপ্রিল কক্সবাজার-১ আসনের সাবেক সাংসদ জাফর আলম ও ২০ এপ্রিল ঢাকা-৫ আসনের সাবেক সাংসদ মনিরুল ইসলাম মনুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ৯ মে রাতভর সমর্থকদের পাহারার পর সকালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আইভীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়।
ঢাকা সেনানিবাসে ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৪০ দিনে সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট নয় হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র ও দুই লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট এক হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৬৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com