মামলার পরিসংখ্যান
জানুয়ারি থেকে জুন, বেড়েছে খুন
প্রকাশ : ১৫-০৭-২০২৫ ১২:৩১

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে খুনের ঘটনা। জানুয়ারিতে সারা দেশে খুনের মামলা হয় ২৯৪টি; যা জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪৪টি। গত ছয় মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ এবং পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনায় মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।
সোমবার (১৪ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের দেওয়া পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এই তথ্য পাওয়া গেছে। প্রেস উইং ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চলতি বছরে অপরাধ বেড়েছে; যা নাগরিকদের মধ্যে ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। তবে তাদের দাবি, চলতি বছর অপরাধ খুব বাড়ছে— এই দাবি পরিসংখ্যান পুরোপুরি সমর্থন করে না। বরং গত ১০ মাসে বড় অপরাধগুলোর ঘটনা একই ধরনের রয়েছে।
সম্প্রতি পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পিটিয়ে, কুপিয়ে এবং ইট-পাথরের খণ্ড দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা উঠেছে। এ অবস্থার মধ্যে প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে দেশের অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হলো।
প্রেস উইংয়ের সরবরাহ করা অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে খুনের মামলা বেড়েই চলছে। জানুয়ারিতে মামলা হয়েছিল ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে তা দাঁড়ায় ৩০০টিতে। এরপর মার্চে খুনের মামলা ৩১৬টি, এপ্রিলে ৩৩৮টি, মে মাসে ৩৪১টি এবং জুনে ৩৪৪টি।
এ ছাড়া ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেও খুনের মামলার বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট দেখা যায়। ২০২০ সালে সারা দেশে খুনের মামলা ছিল তিন হাজার ৫৩৯টি, ২০২১ সালে তিন হাজার ২১৪টি, ২০২২ সালে তিন হাজার ১২৬টি এবং ২০২৩ সালে তিন হাজার ২৩টি মামলা হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালে সাধারণ খুনের ঘটনার পাশাপাশি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নির্বিচার গুলি চালানো হয়। এতে বছরটিতে খুনের মামলার সংখ্যা অনেকটা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ১১৪টিতে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অনেক পুরোনো খুনের ঘটনা ২০২৪ সালে মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে চলতি বছরেও অতীতের তুলনায় খুনের মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে মোট খুনের মামলা ছিল ১২ হাজার ৯০২টি। এই হিসাব অনুযায়ী, প্রতিটি মাসে গড়ে ২৬৯টি খুনের মামলা হয়েছে। গত ছয় মাসে (২০২৪) জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত খুনের মামলা ছিল এক হাজার ৯৩৩টি।
অপরাধের অন্যান্য চিত্রও বেশ মিশ্র। প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে দেশে কোনো বড় ধরনের অপরাধের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে না। বরং সবচেয়ে গুরুতর কিছু অপরাধের হার কমেছে কিংবা আগের মতোই রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির অপরাধের পরিমাণ বেড়েছে। নাগরিকদের সতর্ক থাকতে হবে এবং পাশাপাশি আস্থা রাখতে হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে। এই স্থিতিশীলতার চিত্র পরিসংখ্যানের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে অনেক ধরনের অপরাধের মধ্যে ভিন্ন প্রবণতা দেখা গেছে। যেমন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডাকাতির মামলা হয়েছিল ৭১টি; যা জুনে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৯টিতে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ডাকাতির মোট মামলা ছিল ৩৬৭টি। যদিও ২০২০ সালের পুরো বছরে ডাকাতির মামলা ছিল ৩০২টি, ২০২১ সালে ৩০৮টি, ২০২২ সালে ৪০৬টি, ২০২৩ সালে ৩১৯টি এবং ২০২৪ সালে ৪৯০টি।
একইভাবে দস্যুতার ঘটনায় করা মামলার সংখ্যাও গত ছয় মাসে কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। জানুয়ারিতে দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৭১টি; যা জুনে এসে দাঁড়িয়েছে ১৫১টিতে। গত ছয় মাসে দস্যুতার মামলার সংখ্যা ছিল ৯৭২টি। গত বছরের তুলনায় এবছরের দস্যুতার মামলার সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। ২০২০ সালে সারা বছর দস্যুতার মামলা ছিল ৯৭৮টি, ২০২১ সালে ৯৭১টি, ২০২২ সালে এক হাজার ১২৮টি, ২০২৩ সালে এক হাজার ২২৭টি এবং ২০২৪ সালে দস্যুতার মামলা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪০৫টিতে।
ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং অপহরণের ঘটনা নিয়ে পরিসংখ্যানও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৯২টি মামলা ছিল; যা জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯২টিতে। ছয় মাসের হিসাবে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। তবে বছরভিত্তিক হিসাব করলে, ধর্ষণের মামলা কিছুটা স্থিতিশীল। ২০২০ সালে ধর্ষণের মামলা ছিল ছয় হাজার ৫৫৫টি, ২০২১ সালে ছয় হাজার ৩৪১টি, ২০২২ সালে ছয় হাজার ৩২টি, ২০২৩ সালে পাঁচ হাজার ১৯১টি এবং ২০২৪ সালে ধর্ষণের মামলা ছিল চার হাজার ৩৯৪টি।
এ ছাড়া গত ছয় মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছিল ছয় হাজার ১৪৪টি। গত পাঁচ বছরে নারী নির্যাতনের মামলার সংখ্যা ২০২৩ সালে সর্বনিম্ন ছিল, যেখানে মামলা হয় ১০ হাজার ১৯৮টি। ২০২০ সালে ছিল সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৪৩১টি। সেই তুলনায় নারী নির্যাতন মামলার হার কিছুটা স্থিতিশীল।
অপহরণও একটি উদ্বেগজনক অপরাধ হিসেবে উঠে এসেছে। গত ছয় মাসে অপহরণের মামলা হয়েছিল ৫১৭টি; যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিগত বছরের পুরো পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। ২০২০ সালে অপহরণের মামলা ছিল ৪৮৬টি, ২০২১ সালে ৪৪৫টি, ২০২২ সালে ৪৬০টি, ২০২৩ সালে ৪৬৩টি এবং ২০২৪ সালে ৬৪২টি। গত বছরের শেষ দিকে অপহরণের মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে অ্যাসিড নিক্ষেপ, দাঙ্গা, শিশু নির্যাতন, চুরি, মাদকদ্রব্য উদ্ধার, চোরাচালান, বিস্ফোরক দ্রব্য এবং অস্ত্র আইনের মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও থেমে নেই। গত ছয় মাসে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার ৩২৯টি মামলা হয়েছে। এই সংখ্যাও বিগত বছরের তুলনায় তুলনামূলক বেশি। ২০২০ সালে এমন মামলা ছিল ৪৪৯টি, ২০২১ সালে ৬০৮টি, ২০২২ সালে ৬০১টি, ২০২৩ সালে ৬০৭টি এবং ২০২৪ সালে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মামলা দাঁড়িয়েছে ৬৪২টিতে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ সদর দপ্তর সাধারণত মামলার হিসাব দিয়ে অপরাধ পরিসংখ্যান তৈরি করে থাকে। এই কারণে পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যায় না। যদি পুলিশ মামলার তথ্য গ্রহণে অনীহা দেখায়, তবে পরিসংখ্যানেও অপরাধের সংখ্যা কম দেখাতে পারে। তবে এসব পরিসংখ্যান থেকে সামগ্রিক অপরাধ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেছেন, শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। খুন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে সামনে আসছে। দেশের মানুষের মধ্যে ভয় ও শঙ্কা বেড়েছে। এটিই অপরাধ পরিস্থিতির নেতিবাচক বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। তিনি বলেন, জনগণ যদি নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে সরকারের উচিত হবে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের আস্থার পাশাপাশি অপরাধ মোকাবেলায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com