weather ৩১.৯৯ o সে. আদ্রতা ৭০% , শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পুলিশের সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কীভাবে?

প্রকাশ : ১২-০৬-২০২৫ ১২:৪২

ছবি : সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের পুলিশ বাহিনী একধরনের মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটিয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য নিয়মিত দায়িত্ব পালনের বাইরে চলে যান, কেউ কেউ চাকরিতে আর ফিরে আসেননি। 

যারা এখনো দায়িত্বে আছেন, তারাও কাজ করছেন চরম ঝুঁকির মধ্যে। কারণ, আন্দোলনের সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্রের বড় একটি অংশ সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে; যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।

এই বাস্তবতায় পুলিশ সদস্যরা মনে করছেন, তাদের হাতে মারণাস্ত্র না থাকলে তারা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে সক্ষম হবেন না। সশস্ত্র সন্ত্রাসী বা বিপজ্জনক অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে যদি পুলিশের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র না থাকে, তাহলে তাদের জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে সমাজে পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধা বা ভয়- দুটোই কমে যাবে। পুলিশের কাজ করার ক্ষমতা যেমন হ্রাস পাবে, তেমনি অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

এমন মত প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের এসআই পদমর্যাদার অনেক কর্মকর্তা। বাহিনী ও রাষ্ট্রের রোষানলে না পড়তে তারা তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যদি পুলিশের হাতে মারণাস্ত্র না থাকে, আর তারা হামলার শিকার হয়, তখন দায় নেবে কে? তাদের আত্মরক্ষা কে করবে? 

গত বছর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহারের কারণে নানা বিতর্কের মুখে পড়ে বাহিনীটি। সেই প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পুলিশের হাতে আর কোনো মারণাস্ত্র দেওয়া হবে না, শুধু মাত্র আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বাহিনী ব্যতীত। ১২ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে পুলিশ সদর দপ্তর পর্যন্ত আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শুধু বাহিনীর মধ্যেই নয়, টেলিভিশনের টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলোতেও বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর সরকার পতনের পর সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার সুযোগে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র প্রবেশ করে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন চরমপন্থী, মাদক ব্যবসায়ী, জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের হাতে। সেই সব অস্ত্র এখন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত চুরি, ডাকাতি, খুন, গোলাগুলির মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে, অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে পুলিশের নিজের নিরাপত্তার জন্য মারণাস্ত্র থাকা আবশ্যক।

তবে আন্দোলন বা গণজমায়েত দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত- এমন মত দিয়েছেন অনেকেই। এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি পুলিশে অস্ত্র ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির কাজ করছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন থানায় অগ্নিসংযোগ ও হামলা করে। থানা ও ফাঁড়িতে হামলার পর পাঁচ হাজার ৭৫৩ অস্ত্র ও ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি গোলাবারুদ লুট করে দুর্বৃত্তরা। ৩ সেপ্টেম্বর ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা দেওয়ার শেষ দিন। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লুট ও অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। অভিযানের পরও উদ্ধার হয়নি এক হাজার ৩৬৯টি অস্ত্র।

চায়না রাইফেল লুণ্ঠিত হয় এক হাজার ১০৬টি, উদ্ধার ৯৯১টি। রাইফেল-টি লুণ্ঠিত হয় ১২টি, উদ্ধার ১১টি। এসএমজি-টি ৫৬ লুণ্ঠিত হয় ২৫১টি, উদ্ধার ২২১টি। এলএমজি-টি ৫৬ লুণ্ঠিত হয় ৩৪টি, উদ্ধার ৩১টি, উদ্ধার হয়নি তিনটি। পিস্তল-টি ৫৪ লুণ্ঠিত হয় ৫৩৯টি, উদ্ধার ৩২৫টি। মি.মি পিস্তল লুণ্ঠিত হয় এক হাজার ৯২টি, উদ্ধার ৬৩০টি। এসএমটি লুণ্ঠিত হয় ৩৩টি, উদ্ধার ৩৩টি। বোর শটগান লুণ্ঠিত হয় দুই হাজার ৭৯টি, উদ্ধার এক হাজার ৬৭৫টি। গ্যাসগান লুণ্ঠিত হয় ৫৮৯টি, উদ্ধার ৪৫৮টি। টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার লুণ্ঠিত হয় ১৫টি, উদ্ধার আটটি। সিগন্যাল পিস্তল লুণ্ঠিত হয় তিনটি, উদ্ধার একটি। গোলাবারুদ লুট হয় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি, এখন পর্যন্ত উদ্ধার ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র ব্যবহারের প্রাধিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে। মাঠপর্যায়ে যে কোনো পুলিশি কার্যক্রম যেন ঝুঁকিমুক্ত থাকে সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অস্ত্রের প্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়। কাজেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা তৈরি হওয়ার বিষয়টি অমূলক। চিহ্নিত দুর্ধর্ষ অপরাধী, চরমপন্থি বা সশস্ত্র বিদ্রোহপ্রবণ (ইমারজেন্সি) এলাকায় পুলিশি কার্যক্রমের সময় অবশ্যই যথাযথ অস্ত্র ব্যবহারের জন্য পুলিশ প্রাধিকারপ্রাপ্ত।

পুলিশ প্রবিধানের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, তিন ক্ষেত্রে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো হলো- ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার কার্যকর করা। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১০০ ও ১০৩ ধারা অনুযায়ী, প্রাণহানি, মারাত্মক আঘাত ও অগ্নিসংযোগের দ্বারা অনিষ্ট করাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশকে আক্রমণকারীদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) ১৫৩-তে বলা হয়েছে, নিজেদের (পুলিশের), জনগণের ও সরকারি সম্পত্তি হামলা থেকে রক্ষার জন্য পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

তবে দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় এই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না। তা ছাড়া দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুযায়ী, যখনই ক্ষতির আশঙ্কা শেষ হবে, তখনই আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকারও শেষ হবে।

কোনো সমাবেশ যদি বেআইনিও হয়, তাহলে তা ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি করার আগে হুঁশিয়ারি (ওয়ার্নিং) দেওয়ার বিধান রয়েছে পুলিশ প্রবিধানে। প্রবিধান ১৫৩ (গ)-তে বলা হয়েছে, সব ধরনের চেষ্টা ও ব্যবস্থার পরও যখন জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তখন সবশেষ ব্যবস্থা হিসেবে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। তবে পিআরবিতে এটিকে চরম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

পুলিশ প্রবিধান ১৫৪-তে উল্লেখ করা হয়েছে, গুলি সব সময় নির্ধারিত লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে হবে; একেবারে অপরিহার্য ব্যতীত কোনোরূপ বড় রকম ক্ষতি সাধন করা যাবে না এবং উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া মাত্রই গুলি বন্ধ করতে হবে।

কীভাবে গুলি করা যাবে, সে বিষয়েও পুলিশ প্রবিধানের ১৫৫-তে আছে, গুলি চালানোর নির্দেশ দানকারী কর্মকর্তা গুলিবর্ষণকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন, যাতে সর্বনিম্ন ক্ষতিসাধন করে দ্রুত উদ্দেশ্য পূরণ করা যায়। সমবেত জনতার মাথার ওপর দিয়ে অথবা সমাবেশে থাকা ব্যক্তিদের বাইরে অন্য কোনো লক্ষ্যে গুলি করা কঠোরভাবে নিষেধ। কারণ, এতে দূরবর্তী নিরপরাধ লোক হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার আগে দূরত্ব, লক্ষ্য ও গুলির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এ ছাড়া জনতার সরে যাওয়া ও ছত্রভঙ্গ হওয়ার সামান্যতম প্রবণতা থাকলেও গুলি চালানো বন্ধের নির্দেশনা আছে পিআরবিতে।

সাবেক একজন ডিআইজি বলেন, সন্ত্রাসীরা যদি জানতে পারে পুলিশের কাছে কেবল শটগান আছে, তাহলে তারা আরো সাহসী হয়ে উঠবে এবং পুলিশ নিজেই তখন আক্রমণের শিকার হবে। মারণাস্ত্র না থাকলে পুলিশ আত্মরক্ষার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে।

পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইন্সপেক্টর কামরুল হাসান তালুকদার বলেন, পুলিশ শুধু বিক্ষোভ দমন করে না; জঙ্গি, সন্ত্রাসী, ডাকাত, জলদস্যুদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চালায়। এইসব সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র অপরাধীদের বিরুদ্ধে সফল হতে হলে পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকা দরকার। অস্ত্র থাকলেই যে তা ব্যবহৃত হবে তা নয়, তবে অস্ত্রের উপস্থিতি পুলিশের শক্তি এবং অপরাধীদের জন্য একটি ভয় হিসেবে কাজ করে।

সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ একটি আইনসম্মত শক্তি প্রয়োগকারী বাহিনী। তাদের যদি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তদন্ত বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় তারা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে না। মূল সমস্যা অস্ত্র নয়, বরং অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল, নীতি ও ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হলে অপব্যবহারও কমে আসবে এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে।

পিপলসনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --


CONTACT

ads@peoplenewsbd.com

আইআরজিসি-সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, বিজ্ঞানীসহ ইরানে নিহত হয়েছেন যারা আইআরজিসি-সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, বিজ্ঞানীসহ ইরানে নিহত হয়েছেন যারা রাজধানীর বাজারে সবজি-মুরগির দাম কম, মাছ চড়া রাজধানীর বাজারে সবজি-মুরগির দাম কম, মাছ চড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক শুরু ইসরায়েলে পাল্টা হামলা শুরু ইরানের ইসরায়েলে পাল্টা হামলা শুরু ইরানের কয়েক মিনিট দেরি হওয়ায় বিমানটিতে উঠতে পারেননি ভূমি চৌহান কয়েক মিনিট দেরি হওয়ায় বিমানটিতে উঠতে পারেননি ভূমি চৌহান