লোকসানে পড়ে বাগদা চিংড়ির চাষ ছাড়ছেন কৃষক
প্রকাশ : ২১-০৩-২০২৫ ১৭:২১

ছবি : সংগৃহীত
খুলনা ব্যুরো
এক সময় দুইশ বিঘা জমির বিশাল বাগদা চিংড়ির ঘের ছিল খুলনার ননী গোপাল বৈদ্যের। তবে লোকসানসহ নানা কারণে ২০০৮ সালে বাগদা চিংড়ি চাষ ছেড়ে দেন তিনি।
ননী গোপাল বৈদ্য বলেন, আমি ১৯৯১ সালের দিকে নিজের ছয় থেকে সাত বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু করি। পরে সাত থেকে আটজন মিলে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে দুইশ বিঘা জমিতে ঘের করি। এই জমি আমরা হারিতে (লিজ) নিয়েছিলাম। কিন্তু, বড় লোকসান করে ঘের ছেড়ে দিয়ে আসি।
তিনি বলেন, চিংড়ি চাষ এমন— প্রথম দুই বছর লোকসান হলো, তবে তৃতীয় বছরে হয়তো বছরে পুঁজি বাঁচবে। চতুর্থ বছরে গিয়ে একটু লাভ হলো, কিন্তু কখন যে লোকসানে ডুবে যাবেন বুঝতেই পারবেন না। তাই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে কৃষিতে ফিরেছি।
ননী গোপাল বৈদ্যের পাড়ায় প্রায় আটশ পরিবারের বসবাস। তাদের প্রায় সবাই বাগদা চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখন নেই। এমনকি তার নিজের ইউনিয়ন দাকোপের সুতারখালিতে বিশ হাজার একর জমিতে কোনো চিংড়ি চাষ হচ্ছে না। এ ছাড়া দাকোপ উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের সবগুলোতে চিংড়ি মাছের চাষ হতো। কিন্তু প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
ননী গোপালের দেওয়া তথ্য মতে, প্রায় ৩০ হাজার চাষি চিংড়ি চাষ থেকে সরে এসেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির লবণাক্ততার তারতম্য, চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়া, নিম্নমানের চিংড়ির পোনা, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের অব্যবস্থা এবং মাটি ও পানির শক্তি লাশের কারণে চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা ধীরে ধীরে চিংড়ি চাষ বিমুখ হয়ে অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফএ) তথ্য অনুযায়ী, ১০৯টি নিবন্ধিত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মধ্যে খুলনায় মাত্র ৩০টি এবং চট্টগ্রামে ১৮টি চালু আছে। এই কারখানাগুলো মূলত বাগদা (ব্ল্যাক টাইগার শ্রিম্প) ও গলদা (ফ্রেশওয়াটার শ্রিম্প) চিংড়ির ওপর নির্ভরশীল। তবে কাঁচামালের অভাবে এগুলো টিকে থাকার সংকটে পড়েছে।
বিএফএফএর তথ্য মতে, এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ টন, কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় চিংড়ির মাত্র সাত শতাংশ পাচ্ছে।
পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় চিংড়ির মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পাচ্ছে। এতে সারাবছর কারখানা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।'
তার ভাষ্য, চিংড়ি সংকটে বন্ধ হচ্ছে কারখানা, ভেনামি চাষ সম্প্রসারণে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে—সাইক্লোন আইলা, আম্পান, ইয়াস, রিমেলের আঘাতে চিংড়ি খামার মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছিল। লোকসানে পড়ে অনেক চাষি ঘের ছেড়ে দিয়েছেন।
দেশে চিংড়ি চাষের উর্বর-ভূমি হিসেবে চারটি জেলাকে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হলো—খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার। এসব জেলার চাষিরা রপ্তানিযোগ্য বাগদা ও গলদার বাণিজ্যিক চাষ করেন। তবে গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ পদ্ধতির ভিন্নতা রয়েছে। গলদা স্বাদু পানির মাছ হলেও কম লবণাক্ত পানিতে চাষ করা যায়। তবে বাগদা চাষে প্রয়োজন লবণাক্ত পানি।
সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, ২০০৯ সালের আইলার পর আমার ইউনিয়নসহ দাকোপের প্রায় সবগুলো ইউনিয়নে চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয়রা তখন চিংড়ি চাষবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তবে ঘের মালিক মালিকরা চিংড়ি চাষের পক্ষে ছিলেন। আইলায় কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়ন ডুবে যায়, তখন সব ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় তিন বছর এগুলো পানির নিচে ছিল। তারপর থেকে মূলত চিংড়ি চাষ বন্ধ হয়ে যায়।
আমার ইউনিয়নের ৩৫ হাজার পরিবার আগে বাগদা চাষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ এখন বাগদা চাষের বাইরে আছে, বলেন তিনি।
বাগেরহাট চিংড়ি ঘের মালিক সমিতির সভাপতি ছকির মহিতুল ইসলাম বলেন, বাগেরহাটের সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার চিংড়ি ঘের আছে। প্রায় লক্ষাধিক চাষি এরসঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা এখন নানাবিধ সংকটে আছেন।
তিনি মন্তব্য করেন, ভালো চিংড়ি পোনার অভাব, বিদ্যুৎ সংকট, স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মুভমেন্টসহ নানান সংকটে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
মৎস্য বিভাগের আগ্রহের জায়গায় এখন সেমি ইনটেন্সিভ ফার্ম, সেখানে নানাবিধ প্রণোদন আছে। কিন্তু সনাতন চিংড়ি চাষিদের জন্য কিছুই নেই, বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, গতবছর চিংড়ি চাষিরা তিনবার লোকসানের মুখে পড়েন। ফেব্রুয়ারিতে পোনা ছাড়ার পর পানির অভাবে অনেক মাছ মারা যায়। তারপর ঘূর্ণিঝড় রিমেলে দ্বিতীয়বার লোকসানে পড়তে হয়। কিন্তু চিংড়ি চাষিরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাননি। তাই আমাদের দাবি, চিংড়ি চাষিদের বিমার আওতায় আনা হোক।
নিয়মিতভাবে চিংড়ি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। তাই এই সেক্টরে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি, মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে বাগদা চিংড়ি চাষের জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই লাখ ১৬ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে এক লাখ ৯১ হাজার ৫৭ হেক্টরে নেমে এসেছে। এই আট বছরে প্রায় ২৫ হাজার ৪১১ হেক্টর চিংড়ি চাষের জমি কমেছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন আরো বলছে, গত কয়েক বছরে চিংড়ি চাষের জমি কমার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বাড়া-কমার মধ্যে ছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট উৎপাদন ছিল ৭৫ হাজার ২৭৪ মেট্রিক টন। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন কমে ৬৮ হাজার ২১৭ মেট্রিক টনে নেমে আসে। অবশ্য ২০১৬-১৭ সালে সামান্য বেড়ে ৬৮ হাজার ২৭২ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পতন হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এবং উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৭০৯ মেট্রিক টনে। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে ৬৩ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ৬৮৮ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৭০৪ মেট্রিক টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭০ হাজার ২১৯ মেট্রিক টনে দাঁড়ায়।
ফ্রোজেন ফুড অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও এমইউ সি ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির লবণাক্ততার তারতম্য, চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমা, মানসম্মত পোনার অভাব, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের অপর্যাপ্ততা, মাটি ও পানির শক্তি কমার কারণে চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
মৎস্য অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চিংড়ি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। কিছু কিছু এলাকায় বাগদা চাষের জায়গায় ধান চাষ হচ্ছে। অনেক এলাকায় বাগদা চাষের জন্য লবণ পানি তোলা বন্ধ আছে, আবার কোথাও কোথাও পানি তুলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাগদা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। যারা এতদিন বাগদা চিংড়ি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা ওই জমিতে আর বাগদা চাষ করতে পারছে না। আবার সেখানে ধানের ফলন ভালো হচ্ছে না। এক হেক্টর জমিতে বাগদা চাষ করে যত লাভ হওয়ার কথা, ধান থেকে সেই লাভ হয় না। ফলে বাগদা চিংড়ি চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তার ভাষ্য, একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন চিংড়ির উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঘেরের পানি শুকিয়ে যাওয়া ও নাব্যতা কমার মতো ঘটনা ঘটে। এতে চিংড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে চাষিরা হয়ে হতাশ হয়ে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।
মো. জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, এই সমস্যার সমাধানে জোনিং সিস্টেম করা যেতে পারে। যেমন কোন এলাকায় চিংড়ি চাষ হবে, আবার কোন এলাকায় ধান চাষ হবে, তা নির্ধারণ করে দিলে কোনো বিবাদ হবে না। লবণ পানি তোলার একটু সুযোগ দেওয়া বাগদা চাষিরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে ঘেরগুলোর গভীরতা বাড়ানো ওএসপিএফ (স্পেসিফিক প্যাথোজেন ফ্রি) পোনা নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদন বাড়বে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দশকের পর দশক ধরে চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় যেখানে অন্য ফসলের হয় না, সেই জমিতে চিংড়ি চাষ করে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে লোকসানসহ বিবিধ কারণে চিংড়ি চাষের জন্য খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের চিত্রপট বদলে গেছে।
তারা মনে করছেন, বাগদা চিংড়ি শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বেকার হয়ে পড়বে। ফলে জলবায়ুজনিত কারণে এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ আরো প্রান্তিক হবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com