১৪ জনের হাত ধরে দেশের ৫৪ বাজেট পেশ
প্রকাশ : ০২-০৬-২০২৫ ১৬:১৫

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে আজ সোমবার (২ জুন) দেশের ৫৪তম জাতীয় বাজেট পেশ করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
প্রথমবার তিনি বাজেট পেশ করছেন। ফলে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের ১৪তম বাজেট উপস্থাপক। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নীতিনির্ধারণী প্রেক্ষাপটে এই বাজেট একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বাজেটের আকার সাধারণত ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কিন্তু এবার এই ধারার ব্যতিক্রম ঘটেছে। প্রথা ভেঙে বাজেটের আকার কমেছে সাত হাজার কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটটি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজেট হলেও বিগত অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালের বাজেট ছিল সবচেয়ে বড়— সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সেই বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে ওই বাজেট ঘোষণার কয়েক মাস পরেই রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমান সময়ে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। একইভাবে, সবচেয়ে বড় বাজেট উপস্থাপনকারী অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও দেশ ছেড়ে চলে যান এবং বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
যারা এ পর্যন্ত দেশের বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাজেট উপস্থাপনের গৌরব অর্জন করেছেন দুজন ব্যক্তি— আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এম সাইফুর রহমান। এই দুজনই সমানভাবে ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরে, যেখানে বাজেটের আকার ছিল চার হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে তিনি ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিটি বছরে ধারাবাহিকভাবে বাজেট উপস্থাপন করেন। তার শেষ বাজেট ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার, যা তার দায়িত্বকালে সর্বোচ্চ বাজেট হিসেবে বিবেচিত।
এম সাইফুর রহমান বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে চার হাজার ২২৭ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি বিএনপির বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে বাজেটের আকার ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন। তার সর্বশেষ বাজেট ছিল ২০০৬-০৭ অর্থবছরের ৬৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের তার বাজেট ছিল ৭১৯ কোটি টাকার। এরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ৮২০ কোটি এবং ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৯৯৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করানোর জন্য তার এসব বাজেট ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
তাজউদ্দীনের পর বাজেট উপস্থাপন করেন ড. আজিজুর রহমান (১৯৭৫-৭৬), যার বাজেট ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। এরপর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে তিনটি বাজেট পেশ করেন। তার সর্বশেষ বাজেট ছিল দুই হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে বাজেট উপস্থাপন করেন ড. এম এন হুদা। তার বাজেট ছিল তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
এরপর বাজেট পেশ করেন এম সায়েদুজ্জামান। তিনি ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছর থেকে চারটি বাজেট পেশ করেন; যার সর্বশেষটি ছিল ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন মেজর জেনারেল এম এ মুনিম; যার বাজেট ছিল ১১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। একইভাবে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ড. ওয়াহিদুল হক ১৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর বাজেট পেশ করেন শাহ্ এএমএস কিবরিয়া। তিনি ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০০০-২০০১ অর্থবছর পর্যন্ত ছয়টি বাজেট দেন। তার সর্বশেষ বাজেট ছিল ৪২ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকার। ২০০১-০২ অর্থবছরের বাজেট ছিল তার শেষ বাজেট।
২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তার সর্বশেষ বাজেট ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার।
২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট পেশ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার দেওয়া বাজেটগুলোর আকার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৯-২০ সালে বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এরপর ২০২০-২১ সালে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, ২০২১-২২ সালে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ সালে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।
বর্তমান বাজেট উপস্থাপক ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তার নেতৃত্বে পেশ হওয়া বাজেটকে অনেকেই একটি দিকনির্দেশক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে এই বাজেট কতটা কার্যকর হয়, সেটি আগামী দিনের বাস্তবায়নেই নির্ধারিত হবে।
সর্বশেষ বাজেট উপস্থাপনকারী হিসেবে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কী বার্তা দেবেন এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই বাজেট দেশের অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণে কতটা প্রভাব ফেলবে— সেটিই এখন জাতির কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com