সরকারের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান, তিতুমীর শিক্ষার্থীদের অনশন চলবে
প্রকাশ : ০২-০২-২০২৫ ০০:০৯

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করাসহ সাত দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে অনশন কর্মসূচি চলার মধ্যে শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আবারো একাধিক সড়ক অবরোধ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। টানা তৃতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
অন্যদিকে অবরোধের কারণে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে গুলশান, বাড্ডা, মহাখালী ও তেজগাঁও অঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এরফলে ফলে এসব সড়কে চলাচলকারী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। বিশেষ করে অফিসফেরত মানুষকে দীর্ঘসময় যানজটে অপেক্ষায় থাকতে হয়।
পরে সন্ধ্যায় তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী আলী আহমদ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে আমরণ অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আলী আহমদ জানান, বিশ্ব ইজতেমার জন্য সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আন্দোলন শিথিল থাকবে। অন্যদিকে শনিবার অনশন পালন করার সময় দুইজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এখন পর্যন্ত মোট ছয়জনকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সর্বশেষ রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সে অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে মহাখালীর রেলপথ, আমতলী ও গুলশান লিংক রোডের সড়কপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন তারা। একইসঙ্গে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিতুমীর কলেজে সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণাও দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শনিবার রাতে কলেজটির শিক্ষার্থীদের সংগঠন তিতুমীর ঐক্যের পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচির বিষয়ে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে।
টানা তৃতীয় দিনের মতো শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কলেজের সামনের সড়ক আটকে দেন তারা। এতে মহাখালী থেকে গুলশান-১-এ যাওয়ার বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই সড়কে চলাচলকারী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে মহাখালীতে সড়ক অবরোধ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর আবার কলেজের সামনে ফিরে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে তারা গুলশান-১ নম্বর চত্বরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সন্ধ্যা ৭টার দিয়ে শিক্ষার্থীরা গুলশান-১ নম্বর গোলচত্বর অবরোধ করেন।
এদিকে শিক্ষার্থীরা যখন মহাখালির দিকে যান তখন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমতলী এলাকায় জলকামানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়।
একই দাবিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে তিতুমীর কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে অনশন করেন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মোট ১২ জন শিক্ষার্থী অনশনে যুক্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শনিবার দুজনসহ এখন পর্যন্ত মোট ছয়জনকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শনিবার হাসপাতালে ভর্তি দুই শিক্ষার্থী হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের মফিজুল ইসলাম ও বাংলা বিভাগের আবু নাঈম। তাদের রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে কলেজের প্রধান ফটকের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। এতে মহাখালী থেকে গুলশানমুখী সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দিবাগত রাত চারটা পর্যন্ত সড়কটি অবরোধ করে রাখা হয়। ফলে সারা দিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীবাসী। শুক্রবারও তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কটি অবরোধ করেন। পরে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। তবে শনিবার বিকাল চারটার মধ্যে দাবি মানা না হলে আবার সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, বিকাল সাড়ে চারটার দিকে তারা সড়ক অবরোধ শুরু করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল চারটা থেকেই কলেজের মূল ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সাড়ে চারটার দিকে কলেজের সামনে বাঁশ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেন তারা।
আন্দোলনকারীদের নেতা নায়েক নূর মোহাম্মদ বলেন, শনিবার বিকাল ৪টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা না এলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক অবরোধ করব বলে ঘোষণা দিয়েছিলাম। এর অংশ হিসেবে আমরা ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তা বন্ধ করেছি। আমরা মহাখালী, গুলশানে রাস্তা এমনকি উত্তর সিটি করপোরেশনের এলাকার বিমানবন্দরের রাস্তাও অবরোধ করব।
কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী জাহিদ রানা বলেন, আমরা ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়াসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। আমার ভাইয়েরা এ নিয়ে অনশন করে যাচ্ছেন, অথচ প্রশাসন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাই আমরা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সড়ক অবরোধ করেছি।
তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কেউ এসে বিষয়টি সুরাহা না করছেন, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে।
সড়ক অবরোধের সময় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে শোনা গেছে। তারা বলছেন, ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘তিতুমীর আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘টিসি না টিউই, টিউই টিউই’, ‘আমার ভাই অনশনে, প্রশাসন কী করে’, ‘প্রশাসনের সিন্ডিকেট, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, চলবে না চলবে না’, ‘অধ্যক্ষের সিন্ডিকেট, মানি না মানবো না’, ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছে চলবে’।
এদিকে শনিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ঢাকার সাতটি কলেজের সমন্বয়ে একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি তিতুমীর কলেজের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা আদায়ে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে মন্ত্রণালয় তথা সরকার অবহিত রয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজের সমন্বয়ে একটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে ইউজিসির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। এক্ষেত্রে সরকারি তিতুমীর কলেজের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই কমিটি তিতুমীর কলেজসহ সাতটি কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এই কলেজগুলোর শিক্ষার সুযোগ সুবিধা ও মানোন্নয়নই বর্তমানে সরকারের প্রধান লক্ষ্য এবং এক্ষেত্রে করণীয় সকল বিকল্পই সরকারের বিবেচনায় থাকবে। এ অবস্থায় তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা আদায়ে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই।
সংশ্লিষ্ট সকলকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এমন কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের দাবি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারীদের ‘তিতুমীর ঐক্য’র সাত দফা দাবির মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ, ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রশাসন গঠন করে ২৪-২৫ সেশনের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা, শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত না হলে অনতিবিলম্বে শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসিক খরচ বহন করা।
এ ছাড়া ২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ন্যূনতম আইন এবং সাংবাদিকতা বিষয় সংযোজন, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পিএইচডিধারী শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার গুণগতমান শতভাগ বাড়াতে আসন সংখ্যা সীমিত এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার বিনির্মাণে জমি ও আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করার দাবিও রয়েছে অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের।
এর আগে গত সোমবার রাতে ‘তিতুমীর ঐক্য’র তরফে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
দাবি মানা না হলে বৃহস্পতিবার থেকে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধের ঘোষণাও দেওয়া হয় তখন। সেইসঙ্গে মঙ্গলবার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে ‘শাটডাউন তিতুমীর’ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা এর আগে ৭ জানুয়ারি শিক্ষালয়টির প্রধান ফটকে ‘তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়’ লেখা ব্যানার টানিয়ে দেন।
একই দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর মহাখালীর আমতলী, কাঁচাবাজার ও রেলক্রসিংয়ে শত শত শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। পরদিন ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ‘ক্লোজডাউন তিতুমীর’ কর্মসূচি দেন তারা।
এরপর ৩ ডিসেম্বর তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ওই কমিটি ‘যথাযথভাবে’ কাজ করছে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com