আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কিনছে গাড়ি
প্রকাশ : ০৪-০৯-২০২৫ ১১:৪৩

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের জন্য ৬০টি নতুন গাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মিতসুবিশি পাজেরো কিউএক্স-২৪২৭ সিসি মডেলের প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এ গাড়িগুলো কেনায় ব্যয় হবে ১০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। শুধু মন্ত্রীদের জন্যই নয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জন্যও কেনা হচ্ছে গাড়ি। এই হিসাবে মোট ২২০টি গাড়ি আসছে মাঠ প্রশাসনের জন্য। ফলে সব মিলিয়ে সরকার কিনতে যাচ্ছে ২৮০টি গাড়ি, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৪৫ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, চলতি অর্থবছরে যানবাহন কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনা দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৮ জুলাই জারি করা ওই পরিপত্রে বলা হয়েছিল, পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় নতুন কোনো গাড়ি কেনা যাবে না। কেবল পরিচালন বাজেটের আওতায় প্রাধিকারভুক্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি যদি ১০ বছরের বেশি পুরোনো হয়ে যায় এবং তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে, তবেই অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে নতুন গাড়ি কেনা যাবে। কিন্তু সরকারের পরিবহন পুলে মন্ত্রীদের জন্য যে গাড়িগুলো রয়েছে, সেগুলো নয় বছরের পুরোনো। ফলে নতুন গাড়ি কেনা পরিপত্রের শর্তের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের জন্য টয়োটা ক্যামরি ও মিতসুবিশি ল্যান্সার গাড়ি কেনা হয়েছিল। মন্ত্রীরা ব্যবহার করতেন ক্যামরি, আর প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা ল্যান্সার। প্রতিটি ক্যামরির দাম পড়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টাকা এবং প্রতিটি ল্যান্সারের দাম ছিল ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মধ্যে। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত উপদেষ্টারা ওই গাড়িগুলোই ব্যবহার করছেন। তবে ঢাকার বাইরে গেলে বিভিন্ন দপ্তরের জিপ গাড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এখন নতুন করে কেনা হচ্ছে উচ্চমূল্যের মিতসুবিশি পাজেরো, প্রতিটির দাম এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এই উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনা করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, পরবর্তী সরকার বা মন্ত্রীরা কী গাড়ি ব্যবহার করবেন, তার সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকার কেন নিচ্ছে? এটা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। তার মতে, এই সিদ্ধান্ত কেবল কৃচ্ছ্রসাধন নীতিকে উপেক্ষা করছে না, বরং প্রশ্ন তুলছে— ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য গাড়ি কেনার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে কে দিয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেন, বর্তমান সরকারের ম্যান্ডেট এটা নয়। অনতিবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা উচিত।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ২১ আগস্ট নির্বাচনী কর্মকর্তা ও ভবিষ্যৎ মন্ত্রীদের জন্য ২৮০টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এর মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য ৬০টি গাড়ি রাখার কথা বলা হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড থেকে সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় এসব গাড়ি কিনবে। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান গাড়িগুলো বারবার মেরামতের প্রয়োজন পড়ছে, যা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এসব গাড়ি দিয়ে ভবিষ্যৎ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অফিসিয়াল সফর বা নির্বাচনী এলাকার কাজ চালানো কষ্টসাধ্য হবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ৬ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মন্ত্রীদের গাড়ি কেনার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রীদের গাড়িগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাই নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের জন্য ২৫টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব প্রস্তুত করে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে কমিটি সেটি অনুমোদন দেয়নি। এমনকি গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং বিদেশি ডেলিগেশনদের জন্য উচ্চমূল্যের গাড়ি কেনার প্রস্তাবও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে নাকচ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
২০১৮ সালেও সরকার ওআইসি সম্মেলনের জন্য ৩০টি মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনেছিল। সম্মেলনের পর কিছু গাড়ি তৎকালীন মন্ত্রীদের দেওয়া হয়, বাকিগুলো সরকারি পরিবহন পুলে যুক্ত হয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কোনো গাড়ি যদি বিআরটিএর পরিদর্শনে অকেজো ঘোষণা করা হয়, তবেই সেটি প্রতিস্থাপনের সুযোগ থাকে। মন্ত্রীদের গাড়ির ক্ষেত্রেও এ নিয়ম কার্যকর।
তবে বর্তমান কেনার প্রক্রিয়া আরেকটি বিতর্ক তৈরি করেছে। ১৯৭৩ সালের ‘দি মিনিস্টারস, মিনিস্টারস অব স্টেট অ্যান্ড ডেপুটি মিনিস্টারস (রেমিউনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা মূলত একটি কার ব্যবহারের অধিকারী। পরে আইনে সংশোধন এনে নির্দিষ্ট অফিসিয়াল সফরের জন্য অতিরিক্ত একটি জিপ ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী শুধুই কার কেনা যাবে, জিপ নয়। ফলে আইন সংশোধন ছাড়াই এই কেনাকাটা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য কেনা হচ্ছে ২২০টি গাড়ি। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রতিস্থাপক হিসেবে ১৯৫টি পাজেরো এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জন্য ২৫টি মাইক্রোবাস রাখা হয়েছে। প্রতিটি পাজেরোর দাম ধরা হয়েছে এক কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং প্রতিটি মাইক্রোবাসের দাম পড়ছে ৫২ লাখ টাকা। এই গাড়িগুলো কেনায় ব্যয় হবে ৩৪৩ কোটি টাকার বেশি।
যানবাহন অধিদপ্তরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২৮ কোটি টাকা। কিন্তু নতুন কেনাকাটায় খরচ হবে প্রায় ৪৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৯৬ কোটি টাকার অনুমোদনও দিয়েছে অর্থ বিভাগ। শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, নতুন কেনা জিপগুলো প্রাধিকারভুক্ত হতে হবে, অকেজো ঘোষণা-সংক্রান্ত বিআরটিএর অনুমোদন নিতে হবে এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা মেনে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী মন্ত্রিসভার আকার সর্বোচ্চ ৩৫ জনে সীমাবদ্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ৬০টি গাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com