চিরাপাড়া নদীতে ভাসমান চারার হাট
প্রকাশ : ০৯-০৯-২০২৫ ১২:১৭

ছবি : সংগৃহীত
পিরোজপুর প্রতিনিধি
ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফোটেনি। কুয়াশা ভেজা নদীর বুক চিরে সারারাত ভেসে থাকা নৌকাগুলো ধীরে ধীরে ভিড়তে শুরু করেছে কূলে। এসব নৌকা বোঝাই করা আমন ধানের সবুজ চারা। একে একে ঘাটে নামতেই ক্রেতারা ছুটে আসেন পারে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক সরগরম হয়ে ওঠে।
বিক্রেতাদের হাঁকডাক আর ক্রেতাদের দরদাম মিলিয়ে নদীর বুক যেন পরিণত হয় ভাসমান বাজারে। কেউ দরদাম মিটিয়ে আঁটি আঁটি চারা তুলে নিচ্ছেন নিজের নৌকায়, কেউবা অটোরিকশায় বা ট্রলিতে করে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির পথে। বিক্রেতারা আবার খালি নৌকা নিয়ে রওনা হচ্ছেন বাড়ির দিকে।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা শহরের চিরাপাড়া নদীতে বসে এই হাট। সপ্তাহে দুই দিন— শুক্র ও সোমবার— এই নদীর বুক সরব হয়ে ওঠে ধানের চারায়। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। শুধু কাউখালী নয়, পার্শ্ববর্তী স্বরূপকাঠি, ভান্ডারিয়া, পিরোজপুর সদর, বাগেরহাট, বরগুনা, ঝালকাঠি— এসব জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরাও ভিড় জমান এই হাটে। নদীর ঘাটে নৌকা ভিড়তেই সবুজ চারায় ভরে ওঠে চারপাশ।
কৃষকদের ভাষ্য, শ্রাবণ মাসের শেষে চিরাপাড়া নদীতে আমন ধানের ভাসমান চারার হাট বসতে শুরু করে। দেড় থেকে দুই মাস আগে এসব বীজতলা তৈরি করা হয়, আর সেই চারা বিক্রি চলে আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বর্তমানে ভাদ্র মাস শেষের দিকে, ফলে আরো দুই থেকে আড়াই সপ্তাহ চলবে এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ভাসমান চারার হাট।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, কাউখালী অঞ্চলের জমি আশপাশের জনপদের তুলনায় তুলনামূলক উঁচু। ফলে এখানে জলাবদ্ধতার সমস্যা হয় না এবং বীজতলা সহজে টিকে থাকে। এই কারণে অন্য এলাকার কৃষকরা যখন চারার সংকটে পড়েন, তখন কাউখালীর ভাসমান হাটে এসে প্রয়োজনীয় চারা সংগ্রহ করেন। পরিবহন সুবিধাও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। নদীপথে নৌকা, ট্রলার বা ছোট বড় যাতায়াতের সুবিধা থাকায় সহজেই কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে পারেন। কাউখালী এলাকায় অনেক কৃষক আছেন যারা শুধুমাত্র বীজতলায় বীজ উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। তাদের উৎপাদিত চারা যুগ যুগ ধরে এই নদীবক্ষে বসা হাটে বিক্রি হয়ে আসছে।
এ হাটে আমন ধানের চারা বিক্রি হয় ‘পণ’ হিসেবে। এক পণ মানে ৮০ আঁটি। দুই হাত মিলিয়ে যেভাবে এক মুঠ তৈরি হয়, তার ভেতরে যতটা চারা ধরে, সেটিই এক আঁটি ধরা হয়। এবার এক পণ চারার দাম এক হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। চারা উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম কিছুটা কমে গেছে। হাটে প্রতিবার প্রায় ১০ লাখ টাকার চারা কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
চারা কিনতে আসা ভান্ডারিয়া উপজেলার ভিটাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক বাচ্চু মিয়া বলেন, আমন ধান চাষের জন্য বীজ-ধান জোগাড় করা, বীজতলা তৈরি, তারপর চারা উৎপাদন— এই পুরো প্রক্রিয়ায় সময় ও খরচ দুই-ই বেশি। তাই আমরা অনেকেই সরাসরি হাট থেকে চারা কিনে জমিতে রোপণ করি। এতে সময়ও বাঁচে, খরচও কম হয়।
ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার কৃষক আব্দুল বারেক বলেন, এখন জমি চাষের জন্য শ্রমিক পাওয়া মুশকিল। আর পেলেও প্রতিদিনের মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এত খরচ করে বীজতলা তৈরি করার চাইতে হাট থেকে চারা কিনে নিলে অনেক কম খরচে কাজ সেরে ফেলা যায়।
কাউখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোমা রানী দাস জানান, কাউখালীর জমিগুলো একটু উঁচু ও নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে জলাবদ্ধতার সমস্যা হয় না। একই জমিতে কৃষকরা অল্প সময়ের মধ্যে বীজ থেকে চারা তৈরি করেন এবং পরে ধানও আবাদ করেন। এখানকার চারার মান ভালো হওয়ায় দূরদূরান্তের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এই ভাসমান হাটে ছুটে আসেন।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com