নাফ নদী থেকে সাত মাসে ২২০ জেলেকে অপহরণ আরাকান আর্মির
প্রকাশ : ১৯-০৫-২০২৫ ১০:৫৮

ছবি : সংগৃহীত
কক্সবাজার প্রতিনিধি
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদী ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা সংকটে রয়েছেন জেলেরা। গত সাত মাসে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি অন্তত ২২০ জন বাংলাদেশি জেলেকে অপহরণ করেছে। শুধু ২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৫১ জন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সূত্রে জানা যায়, এই সময়ের মধ্যে বিজিবির সহায়তায় কয়েক দফায় বহু জেলেকে উদ্ধার করে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো বেশ কয়েকজন জেলের কোনো খোঁজ মেলেনি, পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন।
সর্বশেষ ১২ মে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ ধরার সময় আরাকান আর্মির গুলিতে আহত হন দুই তরুণ জেলে— টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের হেদায়েত উল্লাহ (১৮) ও মো. হোসেন (১৬)। একই ঘটনায় তিন জেলে অপহৃত হন। এর আগে ৮ এপ্রিল চারটি ট্রলারসহ ২৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় গোষ্ঠীটি।
আরাকান আর্মির হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফেরা কয়েকজন জেলে জানিয়েছেন, অপহরণের পর তাদের চোখ ও হাত বেঁধে প্রথমে মংডু এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাজতখানার মতো একটি ঘরে রাখা হয়, যেখানে অন্ধকার পরিবেশে গাদাগাদি করে রাখা হতো শতাধিক বন্দিকে।
শাহপরীর দ্বীপের উত্তরপাড়ার মো. আইয়ুব জানান, ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমা পেরিয়ে টেকনাফ ফেরার পথে তাদের ট্রলারে হামলা চালায় সাতজন অস্ত্রধারী। তারা ট্রলারে থাকা নয়জন বাংলাদেশি জেলেকে বন্দি করে মিয়ানমারে নিয়ে যায়।
‘প্রথমে আমাদের চোখ-মুখ বেঁধে নেয়, পরে হাত-পা খুলে হাজতের মতো জায়গায় রাখে। সেখানে আমি ৩১ বাংলাদেশিকে দেখেছি, তবে পুরো বন্দি সংখ্যা ছিল ২০০ থেকে আড়াইশ জন,’ বলেন আইয়ুব।
জিম্মি থাকা অবস্থায় প্রতিদিন দুই বেলা ভাত দেওয়া হতো। খাবারের সঙ্গে শুধু কলাপাতায় কাঁঠালের এঁচোড় থাকত, কোনো লবণ, মরিচ বা হলুদ দেওয়া হতো না। লবণ চাইলে মারধর করা হতো বলেও জানান তিনি।
আরাকান আর্মির সদস্যরা বন্দিদের বলত, বাংলাদেশ থেকে চাল-ডাল, পেঁয়াজ, হলুদ-মরিচ পাঠালে জেলেদের ছেড়ে দেওয়া হবে। বন্দিদশায় ৪১ দিন আলোহীন কক্ষে কাটিয়েছেন বলে জানান আইয়ুব। পরে বিজিবি ও ট্রলার মালিকদের সহায়তায় মুক্তিপণের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করা হয়।
১২ মে গুলিবিদ্ধ হেদায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা পাঁচজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছিলাম। হঠাৎ মিয়ানমার দিক থেকে গুলি করে। আমরা চিৎকার দিলে বাকিরা পালিয়ে যায়। আমি ও হোসেন আহত হই। আমরা বাংলাদেশ জলসীমায় ছিলাম, তবু গুলি করেছে। এখন আর মাছ ধরতে যাওয়ার সাহস পাই না।
এপ্রিলে বিজিবির সহায়তায় এক অভিযানে ৫৫ জেলেকে ফেরত আনা হয়। এর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাংলাদেশি এবং ৪২ জন রোহিঙ্গা, যারা টেকনাফের বিভিন্ন ট্রলারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
নাফ নদীতে মাছ ধরার ওপর দীর্ঘদিন নিষেধাজ্ঞা ছিল। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক চোরাচালান ঠেকাতে ২০১৭ সালের আগস্টে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর জেলেরা আবার নদীতে নামতে শুরু করেন। কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হয় অপহরণ ও গুলির ঘটনা।
অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিজিবি অপহৃতদের উদ্ধার করেছে। জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে ২১ জন, নভেম্বরে ২০ জন, ডিসেম্বরে ৪ জন এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২৯ জন, মার্চে ৮৮ জন, এপ্রিল ৫৫ জন ও মে মাসে তিনজনকে ফেরত আনা হয়।
তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন জানুয়ারিতে অপহৃত আব্দুর শুক্কুরসহ তিনজন জেলে। শুক্কুরের স্ত্রী সাজেদা বেগম বলেন, তিন মাস হয়ে গেছে। চার সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। অনেক দপ্তরে আবেদন করেছি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। ফেরত আসা জেলে আমান উল্লাহ বলেন, আমরা নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্ত থেকে ফেরার পথে ধরা পড়ি। কথা না বলেই গুলি করে আরাকান আর্মি। এক মাস পর ছাড়া পাই।
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ নৌঘাটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর বলেন, নাফ নদীতে মাছ ধরা এখন খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সাগরও এখন বন্ধ। অনেকে পেটের দায়ে নদীতে নামছে। কেউ কেউ ভুল করে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে যায়, তখনই তাদের ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত জেলেরা জানান, বন্দিদশায় থাকা অবস্থায় আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সহায়তা চায় এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় বলে ইঙ্গিত দেয়।
সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা দখলে নেয় আরাকান আর্মি। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের বিপরীত অংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে।
এই দখলের পর থেকেই আরাকান আর্মি সীমান্তে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে এবং সীমান্ত বাণিজ্যেও হস্তক্ষেপ শুরু করে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ বন্দরে আসার পথে চারটি পণ্যবাহী ট্রলার আটক করে গোষ্ঠীটি। পণ্য ছাড়াতে বাধ্য হয়ে কমিশন দিতে হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানান। যদিও প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করেননি।
বিজিবির রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলেরা ভুল করে জলসীমা অতিক্রম করলে আরাকান আর্মি তাদের ধরে। আমরা অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের মাধ্যমে উদ্ধারের চেষ্টা করি। তবে ওরা খাবার চায়, যা সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, মাদক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অনেকদিন নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ ছিল। এখনো কেউ কেউ ককসিটে ভেসে গিয়ে মাছ ধরেন, তখনই বিপদ ঘটে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com