বছরে ২০ হাজার আত্মহত্যা, ৩৫ শতাংশ কিশোরী
প্রকাশ : ১০-০৯-২০২৫ ১১:৪৩

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা এখনো এক বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হয়ে রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২০ হাজার ৫০৫ জন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে কিশোরীরা। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, আত্মহননকারীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক চার শতাংশই কিশোরী এবং বয়সভিত্তিক হিসেবে ১৫ থেকে ১৭ বছরের তরুণীরা আত্মহত্যার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় এ প্রবণতা আরো বেশি।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০২২-২৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এক লাখ ৮৩ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপের অর্থায়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। জরিপের ফলাফল ২০২৩ সালে প্রকাশ করা হয়।
এর আগে ২০১৬ সালেও প্রতিষ্ঠানটি একই ধরনের জরিপ পরিচালনা করেছিল। সেই সময় বছরে ২৩ হাজার ৮৬৮ জন আত্মহত্যা করেছিলেন; যা ছিল প্রতি লাখে ১৪ দশমিক সাত জন। সর্বশেষ জরিপে সেই হার কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১২ দশমিক চার জনে। যদিও সংখ্যাগতভাবে আত্মহননের ঘটনা সামান্য কমেছে, তারপরও আত্মহত্যা একটি বড় সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত হুমকি হিসেবেই রয়ে গেছে।
সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আত্মহত্যার হার কিছুটা কমলেও এর প্রভাব সমাজে অত্যন্ত ভয়াবহ। অনেকেই নানান মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপে পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
আত্মহত্যার প্রবণতা কেন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশি— বিশেষজ্ঞরা তার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। কিশোর বয়সে মানসিক অস্থিরতা, আত্মপরিচয়ের সংকট, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক কলহ, সম্পর্কজনিত জটিলতা ও সামাজিক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা প্রভৃতি বিষয় থেকে হতাশা তৈরি হয়। এই হতাশা থেকে বিষণ্নতা দেখা দেয়, যা সময়মতো চিকিৎসা বা কাউন্সেলিংয়ের অভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম থাকায় তারা ছোটখাটো উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তাকে গুরুত্ব দেয় না, এবং বড় কোনো সংকটে পড়লে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে না পেয়ে আত্মহননের দিকে ধাবিত হয়।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, বিশ্বজুড়েই ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে তরুণরা ব্যর্থতা মোকাবিলা করার শিক্ষা পরিবার ও সমাজ থেকে সঠিকভাবে পায় না। সামান্য বিপর্যয়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এ অবস্থায় অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া। সময়মতো সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে পারলে আত্মহত্যার অনেক ঘটনাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ আট হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে তারা চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়েছে। এগুলো হলো— আত্মহত্যার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর (যেমন কীটনাশক, বিষ বা অস্ত্র) সহজপ্রাপ্যতা সীমিত করা, আত্মহত্যা সংক্রান্ত বিষয়ে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন করার আহ্বান জানানো, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সামাজিক ও আবেগীয় দক্ষতা বিকাশে কাজ করা এবং আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ডা. ক্যাথরিন বোহেম এক বিবৃতিতে বলেছেন, আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য ঘটনা। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীরবতা ও লজ্জার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত সংকট মোকাবিলা করার চেয়ে সম্মিলিতভাবে সমাজকে মানসিক স্বাস্থ্যবান করে তোলা জরুরি। এ জন্য বোঝাপড়া, সহানুভূতি ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সিআইপিআরবির জরিপে দেখা গেছে, শহরের তুলনায় গ্রামে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি। শহরে আত্মহত্যার হার সাত দশমিক ৯২ শতাংশ হলেও গ্রামে তা ১৪ দশমিক আট শতাংশ। বিশেষ করে গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৩৫ দশমিক চার শতাংশ। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ হার ২৮ শতাংশ, ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ, ৪০ থেকে ৬০ ঊর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ১৬ দশমিক দুই শতাংশ এবং ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ হার দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ছয় শতাংশে।
আত্মহত্যার পদ্ধতির দিক থেকেও একটি উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, আত্মহননের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো গলায় ফাঁস দেওয়া, যা ৫০ দশমিক নয় শতাংশ ক্ষেত্রে ঘটেছে। এর পরেই রয়েছে বিষপান; যা ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার মনে করেন, স্কুল পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা উচিত। একই সঙ্গে শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারেন। তিনি বলেন, কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সচেতনতা এখনো অত্যন্ত কম। ফলে ছোট সমস্যাকে আমরা অবহেলা করি, যা পরবর্তীতে ভয়াবহ রূপ নেয়। যদি স্কুল থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা যায়, তবে অনেক আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি পরিবার ও সমাজকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে— এমন মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিভাবকরা যদি সন্তানদের অনুভূতিকে মূল্য দেন, তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে সমাজে আত্মহত্যার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com