প্রত্যাশার চাপ বাড়ছে
বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
প্রকাশ : ০১-০৯-২০২৫ ১০:৩৪

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আজ উদযাপন করছে তাদের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ দল দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী। শাসনক্ষমতায় থাকা, আন্দোলনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়া, দমন-পীড়নের শিকার হওয়া— সব মিলিয়ে বিএনপির ইতিহাস বহুমাত্রিক।
তবে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালিত হচ্ছে। কারণ, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সামনে এসেছে। ফলে জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু আয়োজন— সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আজ বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ মুহূর্তে দলের সামনে যেমন দায়িত্ব বাড়ছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও কম নয়। দেশের মানুষ বিএনপির ওপর আস্থা রেখেছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য। দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের পর আন্দোলনের যে সাফল্য এসেছে, সেটিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় রাজনীতিকে একটি নতুন ধারায় এগিয়ে নেওয়ার সুযোগও এখন দলটির সামনে উন্মুক্ত। একই সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচনকালীন সময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখারও প্রত্যাশা করছে জনগণ।
জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে আসেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালের ১৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়ার আত্মপ্রকাশ হয়। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
বিগত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। আর বিগত বছরের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশ মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়া মামলা, কারাভোগ ও পরে অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। তিনি ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই দল পরিচালনা করছেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকার একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদে মাত্র ৪৫ দিন টিকতে পারে সেই সরকার। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জিতে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। ওই সরকারই ছিল বিএনপির শেষ রাষ্ট্র ক্ষমতা। বিগত ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দলটি।
গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের মানুষের প্রত্যাশা এখন বিএনপির কাছে সবচেয়ে বেশি। রাজনীতিকরা মনে করছেন, আগামী দিনে দেশে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সাহায্য করা, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করতে প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে দলটিকে। একই সঙ্গে তারা মনে করছে, বিএনপি এখন বেশ পরিণত দল।
দলটির নেতারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনে বিএনপির প্রধান নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মী নির্যাতন, নিপীড়ন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু দলটিকে ভাঙা যায়নি। বারবার জেগে উঠেছে। বলেছে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের কথা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা হতাশা ছিল। মানুষ ১৯৭১ সালে দাবি আদায়ের জন্য যুদ্ধে নেমেছিল, তারপর ’৭১ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল সেটা তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পূরণ করতে পারেনি। বরং দুর্ভিক্ষ, চরম অরাজকতা, দলীয়করণ এবং পরে তারা একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। সেই সময় মানুষের প্রত্যাশার জায়গায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সে সময় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ওই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য ১৯ দফা দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। তিনি সেই ১৯ দফার ভিত্তিতে গ্রামগঞ্জ ঘুরে বেরিয়েছেন। মানুষের যে হতাশার জায়গাগুলো ছিল, সেই জায়গা থেকে তিনি মানুষকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের পর মানুষ গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আশান্বিত হয়েছিল। এই গুণগত পরিবর্তন রাজনীতির ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে। বিএনপি তা ধারণ করছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশে এখন নির্বাচনের আবহ তৈরি হয়েছে। যদিও একটি গোষ্ঠী তা বানচালের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন ধরনের উগ্র কথা বলে মানুষকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে। তবে ষড়যন্ত্র কখনও কাজে আসে না। অতীত তাই বলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীরাও মুক্তি পান। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। এতে দলের জনপ্রিয়তা চ্যালেঞ্জে পড়েছে। অনেককে বহিষ্কারসহ নানা শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, বিএনপিই সবচেয়ে বড় দল। মনে করা হয়, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। সেখানে বিএনপিকে যেটা ভাবা দরকার, ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে এক ধরনের সংস্কার হয় আবার বিরোধীদের দৃষ্টিতে এক ধরনের সংস্কার হয়। আমার মনে হয়, বিএনপি এখন ক্ষমতাসীন হিসেবে সংস্কার দেখছে। কিন্তু চিরকাল তো তারা ক্ষমতায় থাকবে না। তাদেরও বিরোধী দলে যেতে হবে। সুতরাং, তারা যদি বিরোধী দলের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে সংস্কার নিয়ে এগোয়, তাহলে বর্তমান সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি। তাদের ‘নতুন প্রতিপক্ষ’ জামায়াতে ইসলামী কিংবা এনসিপি তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ। প্রতিনিয়ত সামাজিক মাধ্যমে গুজব, গুঞ্জন আর ট্রলের মোকাবিলায় বিএনপি যেন পেরে উঠছে না। একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিতও করেছে তারা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশের সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সমর্থন, গণমাধ্যম, ত্যাগী আর যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার মতো চ্যালেঞ্জও নিতে হবে দলটিকে।
দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তিনি বাণীতে বলেন, জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাসহ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য। দেশে এখনো প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আইনের শাসন, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এ জন্য জনগণের নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক সরকার অতীব জরুরি।
তারেক রহমান বলেন, জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে জনগণকে একত্রিত করার লক্ষ্যে মহান স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দিনটি বাংলাদেশি মানুষদের জন্য আনন্দ, উদ্দীপনা ও প্রেরণার। দলটি বাংলাদেশি ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেয়ার নীতিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
পৃথক এক বাণীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে পারলেই নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। দুঃশাসনের যে কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটি সমূলে উপড়ে ফেলে একটি পরমতসহিষ্ণু, শান্তিময় এবং মানবিক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই জাতীয়তাবাদী শক্তির মূল লক্ষ্য হতে হবে।
বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ১৬ সদস্যের ‘জাতীয় উদ্যাপন’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আহ্বায়ক এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
দিনটি উপলক্ষ্যে সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলোতে দলীয় পতাকা উত্তোলন, বেলা ১১টায় শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফাতিহা পাঠ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এদিন দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে আলোচনা সভা ও র্যালি হবে।
মঙ্গলবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালি বের করা হবে। ৩ সেপ্টেম্বর আলোচনা সভা এবং র্যালি হবে উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com