পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন নয়: সৈয়দ রেজাউল করীম
মহাসমাবেশ থেকে ১৬ দফা দিল ইসলামী আন্দোলন
প্রকাশ : ২৮-০৬-২০২৫ ২১:০৮

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (২৮ জুন) অনুষ্ঠিত হয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ। হাজারো নেতাকর্মীর ঢল, বহুল আলোচিত ১৬ দফা দাবি, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার, রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের ডাক এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ঐক্যের প্রত্যয়- সব মিলিয়ে এই মহাসমাবেশ পরিণত হয় এক শক্তিশালী জনমতের বহিঃপ্রকাশে।
মহাসমাবেশে দলটির আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনের বিপক্ষে সাফ কথা বলেন এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে বলে উল্লেখ করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জুলাই অভ্যুত্থানকে ‘রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আন্দোলন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
সমাবেশে ঘোষিত ১৬ দফা দাবিতে সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা পুনঃস্থাপন থেকে শুরু করে নির্বাচনী সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা, ভারত চুক্তি প্রকাশ, অর্থ পাচার রোধ ও ইসলামের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবির মতো বিস্তৃত ও স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরা হয়। এতে অন্যান্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদেরও উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝোতা ও জোটবদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়।
তবে মহাসমাবেশ ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়ে নগরবাসী ভোগান্তিতে পড়ে, আর এর মধ্যেই দেশীয় অস্ত্রসহ এক ব্যক্তির আটক হওয়ার ঘটনাও আলোচনার জন্ম দেয়।
মহাসমাবেশ থেকে ১৬ দফা ঘোষণা: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে দলটির পক্ষ থেকে ১৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ‘মহাসমাবেশের ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন।
মহাসমাবেশকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ধিত অংশ ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি গৌরবময় মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বৈরতন্ত্র রোধে আমাদের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে।
ঘোষণাপত্রে উত্থাপিত ১৬ দফা দাবিসমূহ হলো- ১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিরূপে পুনঃস্থাপন। ২. সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। ৩. জুলাই সনদের ঘোষণা ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণে জাতীয় ঐকমত্য। ৪. ভবিষ্যৎ স্বৈরাচার ও দলীয় কর্তৃত্ববাদ রোধে মৌলিক রাষ্ট্র সংস্কার। ৫. সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে ফ্যাসিবাদী প্রভাবমুক্ত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। ৬. পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার ও পলাতক অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক পদক্ষেপ। ৭. পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ। ৮. সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুন-খারাবি রোধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা। ৯. ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি প্রকাশ ও দেশবিরোধী চুক্তির বাতিল। ১০. জাতীয় নির্বাচনের আগে সব পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন। ১১. দুর্নীতিবাজ, ঋণ-খেলাপি ও সন্ত্রাসীদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। ১২. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিবেশ নিশ্চিত করা। ১৩. ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। ১৪. ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কর্মকাণ্ডে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। ১৫. জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজদের প্রতিহত করা। এবং ১৬. রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামের আলোকিত আদর্শ বাস্তবায়নের আহ্বান।
মহাসমাবেশের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে, যেখানে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন। দুপুর ২টা থেকে মহাসমাবেশের মূল পর্ব শুরু হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করীম চরমোনাই পীর।
পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন নয়-সৈয়দ রেজাউল করীম: দেশের মানুষ পিআর (সংখ্যানুপাতিক) ব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
মহাসমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান জনগণের বিশ্বাস ও আশা-আকাক্ষার পরিপন্থী। এই সংবিধান মেনেই স্বৈরাচার তৈরি হয়েছে। আজ দরকার রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। জুলাই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র শাসক পরিবর্তনের জন্য ছিল না, এটি ছিল একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আন্দোলন।
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ২৪ জুলাইয়ের ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের বিচার না করে নির্বাচন করা চলবে না। গণহত্যা, গুম, লুটপাটের জন্য ফ্যাসিস্ট চক্রের কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।
নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার দাবি করে তিনি বলেন, যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তাদের তত আসন থাকতে হবে। এটি জনগণের, জেনজি প্রজন্মের এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের যৌক্তিক দাবি। প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নিতে হবে।
চরমোনাই পীর বলেন, বারবার রক্ত দিয়েছি, কিন্তু সফলতা পাইনি, কারণ ভুল নেতা ও নীতির হাতে দেশ তুলে দিয়েছি। এবার ইসলামপন্থীদের ঐক্যের সময় এসেছে। এক বাক্সে ভোট নিলে ইসলামপন্থীরাই হবে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা নিঃস্বার্থভাবে এই সরকারের পাশে আছি। তবে সরকার যেন সংস্কার ও নিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচ্যুত না হয়।
কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করব ইনশাআল্লাহ। নারীদের সম্মান ও নিরাপত্তা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ফিলিস্তিন নিয়ে তিনি বলেন, আমরা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির জন্য। উলামায়ে কেরামের মর্যাদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, কিন্তু অবহেলিত। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দায়িত্ব পেলে আপনাদের মর্যাদা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করবে। এখন সময় ঘরে ফসল তোলার। গ্রামে-গঞ্জে, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করে দাওয়াত দিন, ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরুন। আগামীর বাংলাদেশ হবে ইসলামের বাংলাদেশ।
নেতাকর্মীদের ঢল: মহাসমাবেশে নেতাকর্মীদের ঢল নেমেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। শনিবার দুপুর ২টায় মহাসমাবেশের মূলপর্ব শুরু হওয়ার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় ভরে যায়।
সকাল ১০টায় কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় সমাবেশের প্রথম পর্ব। তাতে বক্তব্য দেন সারাদেশ থেকে আসা জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতারা।
সকাল থেকে শাহবাগ, মৎস্যভবন, প্রেস ক্লাব, দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার এলাকায় সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা বাসে করে এসে জড়ো হয়। দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের সবগুলো ফটকে দীর্ঘ জটলা দেখা যায়। উদ্যানে প্রবেশ করতে না পেরে মৎস্য ভবন মোড়ে এলইডি পর্দায় সমাবেশ দেখেন অসংখ্য নেতাকর্মী।
মহাসমাবেশ ঘিরে তীব্র যানজট, নগরবাসীর দুর্ভোগ: মহাসমাবেশ ঘিওে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী, চালক ও পথচারীরা। রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে- ঢাকার বাইরে থেকে আসা কয়েকশ যানবাহন বিভিন্ন সড়কে পার্কিং করে রাখা ছিল।
দুপুরের পর গুলিস্তান থেকে শুরু করে আশপাশের সব সড়ক থেকে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দীর দিকে আসেন। আর সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্তও ছিল একই অবস্থা। এতে করে এসব সড়ক এড়িয়ে গণপরিবহন চলেছে বিকল্প পথে। বিশেষ করে মৎস্য ভবন মোড় দিয়ে শাহবাগ ও ফার্মগেটগামী গাড়িগুলো চলে হেয়ার রোড ও কাকরাইল দিয়ে। মানুষের চাপে রিকশায় চলাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সড়কে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের জন্য দুর্ভোগ বাড়ে বলে জানান যাত্রী ও পথচারীরা।
অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দীর্ঘ দিন পর এত বড় সমাবেশ হওয়ায় সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছেন। এতে সাময়িক কষ্ট হলেও নগরবাসী পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নেবেন বলে তাদের প্রত্যাশা।
মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, বোধিজ্ঞান ভাবনা কেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মূসা বিন ইজহার, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমাদ আবদুল কাদের, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি, এনসিপি’র সদস্য সচিব মুহাম্মদ আখতার হোসাইন ও উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দীন, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদিক হক্কানি এবং এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com