মাটি ছাড়াই সবজির চারা উৎপাদন ঝিনাইদহে
প্রকাশ : ২৬-০৪-২০২৫ ১১:১১

ছবি : সংগৃহীত
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক কৃষি চাষ পদ্ধতি হলো পলিনেট হাউজে প্লাস্টিকের ট্রেতে সবজির চারা উৎপাদন। এসব চারার সঙ্গে মাটির কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে মাটির স্পর্শ ছাড়াই প্লাস্টিকের ট্রেতে জৈবসার মিশ্রণ ও নারিকেলের ছোবড়ার মধ্যে বীজ বপণ করে চারা উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধতির নাম কোকোপিট।
এ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে কোনো কীটপতঙ্গও আক্রমণ করতে পারে না। ফলে সুস্থ ও সবলভাবে চারাগুলো বেড়ে ওঠে। আর এইসব অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে সবজির চারা উৎপাদন করছেন কৃষি উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান।
সরেজমিন দেখা যায়, শৈলকুপা উপজেলার ভাটই বাজারের পাশে টাইটান এগ্রো নামে নার্সারিতে পলিনেট শেডের চারদিকে নেট (জাল) দিয়ে ঘিরে কোকোপিট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছেন সাইদুর রহমান। ২০২১ সালে করোনাকালীন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষিতে আগ্রহী হন তিনি। একপর্যায়ে চারা কিনতে ঝামেলা হওয়ায় নিজেই ভালো এবং মানসম্মত চারা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে অনলাইনের মাধ্যমে নারিকেলের ছোবড়া, প্লাস্টিকের ট্রে-সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন করেন। প্রথমে পাঁচ হাজার চারা উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে তার নার্সারিতে তিন লাখ চারা তৈরির ধারণক্ষমতা রয়েছে।
টাইটান এগ্রো নার্সারিতে দেখা যায়, কলা, টমেটো, মরিচ, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, স্কচ, লেটুসপাতা, পেঁপে, লাউ, ফুলকপি, গাজর, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ও বাধাকপিসহ ১৫ থেকে ২০ ধরনের চারা তৈরি হচ্ছে। প্রথমদিকে তেমন সাড়া না পেলেও বর্তমানে প্রতি মাসে তিন থেকে চার লাখ টাকার চারা বিক্রি হচ্ছে এই নার্সারি থেকে; যা নিজের ও আশপাশের কৃষকের চাহিদা মিটিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। আধুনিক এই নার্সারিতে চারা তৈরি ও পরিচর্যায় কাজ করছেন পাঁচ জন শ্রমিক। প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয় তাদের।
সবজির চারা কিনতে আসা আকরাম হোসেন বলেন, টাইটান এগ্রোতে ভালো মানের সবজির চারা পাওয়া যায়। এ কারণে এখান থেকে সবজির চারা কিনতে এসেছি।
প্রতিবেশী কৃষক সজিব হাসান বলেন, কৃষকরা অনেক সময় ভালো মানের বীজ বা চারা সংগ্রহ করতে পারেন না। কিন্তু টাইটান এগ্রো ভালো মানের বীজ থেকে কোকোপিট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছে। এখান থেকে কৃষকেরা অল্প সময়ের মধ্যে কম দামে ভালো মানের চারা কিনতে পারছে। আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের কৃষক এখান থেকেই সবজির চারার চাহিদা মিটিয়ে থাকেন।
টাইটান এগ্রো নার্সারির ম্যানেজার বলেন, এই নার্সারির উদ্দেশ্য হলো ভালো মানের চারা উৎপাদন করা। মাটিবিহীন কোকোপিট দিয়ে সুস্থ সবল উন্নতমানের চারা তৈরি করছি। একজন কৃষক ভালো বীজ পেলেও সুস্থ সবল চারা তৈরি করতে পারেন না, খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রাকৃতিক আবহাওয়া, বৃষ্টি এবং মাটির কারণে বীজ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা বেশি থাকে। কিন্তু এখানে পলি হাউসে এই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করছি, এখানে বৃষ্টির পানি বা অন্য প্রাকৃতিক আবহাওয়ায় চারা নষ্ট হওয়ার কোনো শঙ্কা নাই। চারপাশ নেট দিয়ে ঘেরার কারণে পোকামাকড় আক্রান্ত করতে পারে না, রোদ বৃষ্টির সমস্যা নাই, যখন যেমন প্রয়োজন তেমন তাপমাত্রা দেওয়ার কারণে সবগুলো চারা একই রকম হয়। যার কারণে একই সঙ্গে চাষ করা যায়। কৃষকরাও এখান থেকে সুস্থ ও উন্নত মানের চারা কিনতে পারছেন।
উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। কৃষিকাজ করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে চারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেখান থেকেই এ কাজে যুক্ত হই। প্রথমে নিজের চাহিদা মিটাই। এরপর কৃষকরা আমাদের কাছে চারা চাইলে কৃষকদের কথা মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন করেছি। যে ধরনের সবজির চারা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী চারা প্রডাকশন করে থাকি এবং কৃষকদের সহযোগিতা করে থাকি।
তিনি বলেন, একজন কৃষকের একটি সবজির চারা তৈরি করতে ৩৫ থেকে ৪০ দিন সময় লাগে। এ ছাড়া বিভিন্ন সার কীটনাশক প্রয়োজন হয়। আমরা সেই কৃষকের চারা তৈরির প্রথম কাজটাই করে দিচ্ছি। এখানে কৃষকেরাও অনেক উপকৃত হচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করে থাকেন। বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে অবগত করে দেওয়া এবং কোন সময় কী করতে হবে, এ ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
তিনি আরো বলেন, এখানে আমরা মাটির কোনো স্পর্শ ছাড়াই উন্নতমানের চারা তৈরি করে থাকি। কোকোপিটের এই পদ্ধতিতে চারা মৃত্যুর হার ও রোগবালাই খুবই কম। কোকোপিট তৈরি করতে প্রথমে নারিকেলের ছোগলা পানিতে ভিজিয়ে রাখি। এরপর সেগুলো ভালো করে শুকিয়ে তার সঙ্গে জৈব সার, জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করে চারা রোপণ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এরপর প্লাস্টিকের ট্রেতে কোকোপিট দিয়ে চারা রোপণ করা হয়। সঠিক পরিমাণে পানি দিয়ে সঠিক আবহাওয়ায় রাখার পর এক সপ্তাহের মধ্যেই চারা গজিয়ে যায়। সর্বমোট ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আমাদের এখানকার চারাগুলো মাটিতে লাগানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়।
তিনি বলেন, বাজারের অন্যান্য চারা থেকে একটু দাম বেশি হলেও এই চারার মৃত্যু হার একদমই কম। কৃষকরা এই আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদন হওয়া চারা দিয়ে চাষ করলে বেশি লাভবান হবে।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্ঠীর চন্দ্র রায় বলেন, শৈলকুপা উপজেলাতে টাইটান এগ্রো বর্তমানে উন্নতমানের চারা উৎপাদন করছে। এখানে কোকোপিটের মাধ্যমে পলিনেটেট হাউসে চারা উৎপাদনের জন্য কারিগরি পরামর্শ দিয়ে আসছি। সেই সঙ্গে এই চারার প্রাপ্তি সম্পর্কে বিভিন্ন কৃষকের মাঝে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছি।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com