weather ২২.৯৯ o সে. আদ্রতা ৮৮% , রবিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মিরপুরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে আগুন, ১৬ মৃত্যু

প্রকাশ : ১৪-১০-২০২৫ ২৩:৪২

ছবি : সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর মিরপুর শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি- ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। 

আগুন লাগার সময় কারখানার গেট বন্ধ ছিল, ফলে ভেতরে থাকা শ্রমিকরা বের হতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। সর্বশেষ জ্বলছে কেমিক্যালের গুদাম, যেখানে আছে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। 

আহত অবস্থায় তিনজনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ বহু শ্রমিক, ভবনের বাইরে স্বজনদের আহাজারি আর উৎকণ্ঠা হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। 

আগুনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন রাজনতিক দলের নেতারা শোক জানিয়েছেন। 

জানা যায়, শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানা ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ ও ‘কসমিক ফার্মা’ নামের রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিরা বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের বরাতে জানা যায়, রাসায়নিকের গুদামের আগুন নেভেনি। পোশাক কারখানার আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণচেষ্টার পাশাপাশি সেখানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখানে এই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শিয়ালবাড়িতে চারতলা ভবনে থাকা একটি পোশাক কারখানা এবং তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।

এর মধ্যে কারখানা থেকে নয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম নিশ্চিত করেন। পরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৬ জন হওয়ার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস।

বিকালে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তল্লাশি অভিযান চলমান। পাশের যে কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে, সেখানে এখনো আগুন জ্বলছে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওখানে কাউকে যেতে দিচ্ছি না। আমরা সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে, ড্রোন দিয়ে এসব কার্যক্রম করছি।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, আগুনের সূত্রপাত এখনো জানা যায়নি। যারা শুরুতে আগুন নেভাতে এসেছেন, তারা রাসায়নিকের গুদাম ও গার্মেন্টস দুই দিকেই আগুন দেখেছেন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, পোশাক কারখানার নিচতলায় ‘ওয়াশ ইউনিট’ রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন চারতলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন লাগার পর কারখানা থেকে শ্রমিকেরা নানাভাবে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই অনেকে আটকা পড়েন।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, রাসায়নিকের গুদামে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

ঘটনার পর থেকে রাসায়নিকের গুদামের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাউকে পাওয়া যায়নি বলে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানান ফায়ার ব্রিগেডের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, এই রাসায়নিকের গুদামের অনুমোদন নেই। যাচাই-বাছাই করে তদন্ত করে বিস্তারিত পরে জানা যাবে।

এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তিনজন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান।

মঙ্গলবার কসমিক ফার্মা নামের একটি কেমিক্যাল গোডাউন এবং পাশের পোশাক কারখানায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট সেখানে নিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। 

পোশাক কারখানার দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নিহতরা নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, গোডাউনে ছয় থেকে সাত ধরনের কেমিক্যাল ছিল। আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই তা দ্রুত ছড়িয়েছে, তাই গার্মেন্টস অংশে থাকা কর্মীরা বাইরে বের হতে পারেননি এবং ছাদেও উঠতে পারেননি। তাই তাদের মৃত্যু হয়েছে।

১৪ বছর বয়সী ভাগনি মাহিরার ছবি হাতে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম। মাঝেমধ্যে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ভাগনি মাহিরা পোশাক কারখানার তিন তলায় কাজ করতো। তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আগুন লাগার পর থেকে আমরা তাকে খুঁজছি। আশপাশের হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি, কোথাও পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলেছেন ধৈর্য ধরতে।

নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম বলেন, আমার বোন সকাল পৌনে ৮টায় কাজে আসে। বেলা সাড়ে ১১টায় খবর পাই আগুন লেগেছে। সেখানের একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারি কেউ ভেতর থেকে বের হতে পারেনি। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি। এখনো কোনো খোঁজ নেই আমার বোনের।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে পোশাক কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা রাসায়নিকের গোডাউনেও। খবর পেয়ে একে একে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। এরপর তাদের সঙ্গে সহায়তায় যোগ দেন পাশে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি।

উদ্ধার লাশ পুড়ে অঙ্গার, পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা লাগবে: শিয়ালবাড়িতে আগুনের ঘটনায় যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে যে দেখে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।

উদ্ধার লাশগুলোর মধ্যে কতজন নারী এবং কতজন পুরুষ তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেও জানান ফায়ার ব্রিগেডের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

গেট বন্ধ করে দেওয়ায় কেউ বের হতে পারেনি, অভিযোগ স্বজনদের: মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, ঘটনাস্থল ঘিরে রাখেন উৎসুক জনতা ও নিখোঁজদের স্বজনরা। চারপাশে কান্না আর উৎকণ্ঠার ছাপ। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভবনটি ঘিরে রাখেন। কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বিকাল ৫টার দিকে নতুন করে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। তখন স্বজনদের মধ্যে নতুন করে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের ধারণা, ভেতরে হয়তো আরও মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।

এই গার্মেন্টস কারখানাতেই কাজ করতেন ২০ বছর বয়সী রবিউল্লাহ। সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পায় না পরিবার। ছেলের খোঁজে ছুটেন মাÑ একবার পুলিশের দিকে, একবার সেনাবাহিনীর কাছে, আবার ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কাছে। কোথাও থেকে কোনো খবর মিলে না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলেটা আমার বেঁচে আছে তো? আবার চোখ মুছে তাকাচ্ছেন আগুনের ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা ভবনের দিকে।

রবিউল্লার বড় ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, আমার ভাই এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। যার কাছে যাচ্ছি কেউ কিছু বলতে পারছে না। সকালে আগুন লাগার পর নিচের গেট বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তাই তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। ওই দুই ফ্লোরে প্রায় ১০০ জন ছিলেন।

এই অভিযোগের সঙ্গে মিলে যায় আরো কয়েকজন স্বজনের বক্তব্য। তারা জানান, আগুন লাগার সময় ভেতরে অনেক শ্রমিক আটকা পড়েছিলেন। কেউ কেউ কাচ ভেঙে বের হতে পেরেছেন, কিন্তু অধিকাংশই বের হতে পারেননি।

ঘটনাস্থলে থাকা নিপা নামে এক নারী জানান, তার বোনের ছেলে রবিন পোশাক কারখানার তিন তলায় কাজ করতেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর থেকে ওর কোনো খবর নেই। বারবার ফোন দিয়েছি, কোনো সাড়া পাইনি। এখন জানি না, ও বেঁচে আছে কি না।

একইভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাগনি মাহিরার ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমার ভাগনি মাহিরা তিন তলায় কাজ করতেন। আগুন লাগার পর থেকে ওর কোনো খবর নেই। চারদিকে খুঁজেছি, হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছিÑ কোথাও পাইনি।

পিপলসনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --


CONTACT

ads@peoplenewsbd.com

‘পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাচ্চা রেখে গেলাম’ ‘পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাচ্চা রেখে গেলাম’ উত্তরার সড়কে ঝরল ভ্যানচালক যুবকের প্রাণ উত্তরার সড়কে ঝরল ভ্যানচালক যুবকের প্রাণ ১৬ মাস পর পাবনায় গেলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ১৬ মাস পর পাবনায় গেলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গাঁজা বিক্রি করতে নিষেধ করায় ছাত্রদল নেতা সাম্য খুন : ডিবি গাঁজা বিক্রি করতে নিষেধ করায় ছাত্রদল নেতা সাম্য খুন : ডিবি নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন আর নেই নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন আর নেই