লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে যেভাবে হত্যা করা হয়
প্রকাশ : ১২-০৭-২০২৫ ১১:৩০

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের উপর উঠে লাফায় কেউ কেউ।
ওই ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, মামলার এজাহার, নিহত লাল চাঁদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বর্ণনায় হত্যাকাণ্ডের এমন বিবরণ উঠে এসেছে।
বুধবার (৯ জুলাই) মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ) হাসপাতালের সামনে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এসেছে। মামলার তদন্তকারী ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল কারণ চাঁদাবাজি। নিহত লাল চাঁদ একসময় যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
লাল চাঁদ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) একটি মামলা হয়েছে। নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম (৪২) মামলাটি করেন। এতে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরো ১৫-২০ জনকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান শুক্রবার (১১ জুলাই) বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে মাহমুদুল হাসান ওরফে মহিন এলাকায় যুবদল নেতা পরিচয় দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে। আরেকজন হলেন তারেক রহমান ওরফে রবিন। বাকি দুজনের নাম জানা যায়নি।
ডিএমপি শুক্রবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মাহমুদুল ও তারেককে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারেকের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে র্যাবের এক বার্তায় বলা হয়, চাঁদা না দেওয়ায় ভাঙারি ব্যবসায়ীকে হত্যার ঘটনায় দুজনকে কেরানীগঞ্জের ইবনে সিনা হাসপাতাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে র্যাব তাদের নাম জানায়নি।
প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যার এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নিথরভাবে পড়ে থাকা লাল চাঁদের শরীরের ওপর কয়েকজন ব্যক্তিকে কংক্রিটের বড় খণ্ড দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায়। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ ঘটনার প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করছে।
এরই মধ্যে শুক্রবার সন্ধ্যায় এই মামলার দুই আসামিকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী যুবদল। তারা হলেন কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক জলবায়ুবিষয়ক সহসম্পাদক রজ্জব আলী ওরফে পিন্টু (মামলার ১৩ নম্বর আসামি) এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম ওরফে লাকি (১১ নম্বর আসামি)। যুবদলের বহিষ্কার-সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই দুজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানানো হয়েছে।
হত্যা মামলার আরো দুই আসামিকে নিজেদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা হলেন চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্যসচিব অপু দাস (১৭ নম্বর আসামি) এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু (১২ নম্বর আসামি)।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে এক বার্তায় জানান, মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে পাকা রাস্তার ওপরে লাল চাঁদকে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ ঘটনা সংঘটিত হয়।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনা: এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় লাল চাঁদের বোন উল্লেখ করেন, লাল চাঁদ বংশাল থানা এলাকার রজনী বোস লেন-সংলগ্ন মসজিদের পাশে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায়িক বিভিন্ন বিষয়সহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আসামিদের সঙ্গে লাল চাঁদের বিরোধ চলছিল। এর জেরে আগেও আসামিরা লাল চাঁদের ভাঙারির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের গুদামে তালা দিয়েছিলেন। তার ভাইকে এলাকাছাড়া করতে বিভিন্ন সময় ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছিলেন আসামিরা।
ঘটনার দিনের বর্ণনায় মামলার এজাহারে বলা হয়, সেদিন (বুধবার) সন্ধ্যা ৬টার দিকে নাম উল্লেখ থাকা ১৯ আসামিসহ অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ আসামি বংশালে লাল চাঁদের সোহান মেটাল নামের ভাঙারির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেন। তখন তাদের সঙ্গে ধারালো দা, প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার রড ও লাঠিসোঁটা, সিমেন্টের কংক্রিট, ইট, পাথরের টুকরা ছিল। আসামিরা লাল চাঁদকে দোকান থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করেন।
এজাহারে আরো বলা হয়, মারধর করে টেনেহিঁচড়ে লাল চাঁদকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতরে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে আসামিরা লাল চাঁদকে এলোপাতাড়িভাবে লোহার রড, ভারী লাঠি এবং সিমেন্টের ব্লক–ইট দিয়ে আঘাত করেন। আঘাতে তার মাথার দুই পাশে গুরুতর জখম হয়। এ ছাড়া লাল চাঁদের ডান কান, ডান চোখের ওপরে, বাঁ হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে জখম করা হয়।
একপর্যায়ে হামলাকারীরা লাল চাঁদকে মারধর করে বিবস্ত্র করেন। আসামিদের আঘাতে লাল চাঁদ রক্তাক্ত অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের ভেতরে ড্রেনের পাশে লুটিয়ে পড়েন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেখান থেকে তাকে টেনেহিঁচড়ে পাকা রাস্তার ওপর নিয়ে ফেলা হয়। পরে লাল চাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে আসামিরা আনন্দ-উল্লাস করেন।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com