শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আবারো তৎপর, রাজধানীতে বাড়ছে খুনোখুনি
প্রকাশ : ২৮-০৫-২০২৫ ১০:৫৩

সেনাবাহিনীর অভিযানে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার (বাঁ থেকে) আরাফাত, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও শরিফ, ছবি: আইএসপিআর
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানী ঢাকায় আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দীর্ঘ সময় নিরব থাকার পর সম্প্রতি এসব গোষ্ঠীর মধ্যে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, দখল, খুন ও হামলার ঘটনা বাড়ছে। অনেক স্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরোধ দেখা দিচ্ছে। এতে করে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
গত দুই মাসে রাজধানীতে সংঘটিত অন্তত তিনটি হত্যাকাণ্ডে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা ও গুলশানসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত আটটি ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই সন্ত্রাসীরা সরাসরি অপরাধ সংঘটনের পাশাপাশি ভাড়ায় খাটতেও দেখা যাচ্ছে।
সর্বশেষ গত ২৬ মে রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কেবল টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে জানা গেছে। এতে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের সহযোগীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিল এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদার। সেই ঘটনার পেছনেও সুব্রত বাইনের নাম উঠে আসে।
মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার কালীশংকরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। এর আগে আরিফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মিরাজ, অনিক ও শুটার বিপুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র্যাব। বিপু ছিলেন সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
আরিফ হত্যার আগেই, ১৩ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেট এলাকার একটি ক্লাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা মো. রাজনকে কুপিয়ে ও মাথায় আঘাত করে গুরুতর জখম করা হয়। ঘটনাস্থলে তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যাওয়া হলেও, পরে তিনি চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তদন্তে জানা যায়, এ ঘটনায়ও সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে মোল্লা মাসুদ ও শুটার বিপু হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা মামলার আসামি। রাজন বলেন, ময়লার টাকা নিয়ে একটি দলের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। এরপর ক্লাবে ঢুকে তারা গুলি করে। গুলি লাগেনি। পরে সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে মাথায় আঘাত করে, কাচের গ্লাস দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। এই সন্ত্রাসীরা টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে পুরোনো অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পায়। তাদের মধ্যে রয়েছেন কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম রাসু, খন্দকার টিটন প্রমুখ।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেউ কেউ বিদেশ থেকে ফিরে আবারো অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে। কেউ কেউ সরাসরি মাঠে না নামলেও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয় হয়েছে নতুন প্রজন্মের অপরাধীচক্র। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. নাসিরুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা রোধে এলাকাভিত্তিক নজরদারি চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কিছু এলাকাতে আগের তুলনায় অপরাধ কমেছে, তবে যেসব ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম উঠে আসছে, সেগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিশেষ সূত্র জানায়, মগবাজার-হাতিরঝিল এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দফায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় একটি গোষ্ঠী সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে এদের মধ্যে খুনোখুনিও হচ্ছে।
যুবদল নেতা আরিফ শিকদার হত্যার পেছনে রয়েছে মগবাজার ও রামপুরা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুব্রত বাইন ও দুবাইয়ে পলাতক অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের বিরোধ। আরিফ শিকদার ছিলেন জিসানপন্থী বিএনপি নেতাদের ঘনিষ্ঠ। সেই কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
১৪ মে এক বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাকে মোল্লা মাসুদের পরিচয়ে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ভুক্তভোগী জানান, তাকে সুব্রত বাইনের লোক পরিচয় দিয়ে একজন চাঁদা চান।
এর আগে মহাখালী ও নিকেতনের ময়লা সংগ্রহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসের নাম সামনে আসে। তার পরিচয়ে ফোনকল ও কয়েক দফা হামলার কারণে চার দিন ওই এলাকার ময়লা সংগ্রহ বন্ধ ছিল। ডিএনসিসির আওতাধীন এই এলাকায় আগে ক্ষমতা ছিল আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলরের হাতে। সরকার পতনের পর বিএনপিপন্থীরা নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর বিকাশ বিশ্বাসের নাম করে ময়লা অপসারণ বন্ধ রাখতে বলা হয়। নির্দেশ অমান্য করায় হামলা চালানো হয়।
অন্যদিকে মতিঝিল এলাকার দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও জিসান আহমেদও বিদেশ থেকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এলাকাভিত্তিক অপরাধে যুক্ত রয়েছেন। বাড্ডা ও গুলশানে জিসানের সহযোগীদের বাইরে আরো চারটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের নেতৃত্বে রয়েছেন সুব্রত বাইন, মেহেদী, রবিন ও হেলাল উদ্দিন।
গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, মেহেদী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এবং রবিন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। রবিনের ভাই মাহবুব এখন গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। হেলাল বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থান করছেন, তবে মাঝে মাঝে গুলশানেও দেখা যায়। বাড্ডা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দেখা না মিললেও তাদের সহযোগীদের আমরা গ্রেপ্তার করছি। এতে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
গত ২০ মার্চ গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনে টেলি সুমন নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুমন ছিলেন রবিন গ্রুপের সদস্য এবং কেবল ও ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসার আড়ালে চাঁদাবাজিতে যুক্ত। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার হন এবং জানুয়ারিতে আবার গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হন। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। র্যাব জানিয়েছে, মেহেদীর নির্দেশে তাকে হত্যায় পাঁচজনের একটি কিলার গ্রুপ কাজ করেছিল।
এদিকে চলতি বছরের ১৬ মে মগবাজার ও হাতিরঝিল এলাকায় দেয়ালজুড়ে দেখা যায় পোস্টার, যেখানে লেখা ছিল, ‘৩৬ নম্বর ওয়ার্ড হাতিরঝিল থানা যুবদলের সক্রিয় কর্মী আরিফ শিকদার হত্যার বিচার চাই।’ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সুব্রত বাইনের অনুসারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে, যা জনমনে আরো আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ মগবাজারের ‘বিশাল সেন্টার’ শপিং মলে সুব্রত বাইনের উপস্থিতি আতঙ্ক সৃষ্টি করে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। সেই থেকেই ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, দখল ও সহিংস ঘটনার পেছনে বারবার সুব্রত বাইনের নাম উঠে আসে। সুব্রত বাইন ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তার গ্রেপ্তারে পুরস্কার ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ইন্টারপোলের রেড নোটিশে তার নাম রয়েছে। রেড নোটিশ অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৫৬ বছর।
কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদের পাশে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে যৌথ বাহিনী সুব্রত বাইনকে গ্রেপ্তার করে। একই অভিযানে ধরা পড়ে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদসহ আরো তিনজন। তবে সুব্রত বাইনের গ্রেপ্তার সত্ত্বেও রাজধানীর মগবাজার, মতিঝিল, বাড্ডা ও গুলশান এলাকায় তার অনুগত সন্ত্রাসীরা এখনো সক্রিয় রয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বরাবরই নজরদারির আওতায় রাখা উচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন নজরদারির ঘাটতির ফলে তারা আবারো সংগঠিত হয়ে উঠছে এবং একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, এখনই এদের কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ বলেন, যেসব মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম এসেছে, সেগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করা জরুরি। আদালতে যদি অপরাধ প্রমাণিত হয়, তবে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। পাশাপাশি দেশে যারা এসব সন্ত্রাসীদের হয়ে কাজ করছেন, তাদের ওপরও কঠোর নজরদারি এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com