weather ২৬.৯৯ o সে. আদ্রতা ৭৪% , সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ২৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসরায়েলের গোপন কারাগার ‘রাকেফেত’, আলো পৌঁছে না যেখানে

প্রকাশ : ১০-১১-২০২৫ ১০:৪৩

ছবি : সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইসরায়েলি দখলনীতির অন্ধকার ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায়ের নাম ‘রাকেফেত’। মাটির নিচে থাকা এই কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের এমনভাবে আটক করে রাখা হয়েছে যে তারা দিনের আলো পর্যন্ত দেখতে পান না। বাইরে কী ঘটছে, পরিবার কেমন আছে, এমনকি নিজেরাই কোথায় আছেন— এই মৌলিক তথ্য থেকেও তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল (পিসিএটিআই) জানিয়েছে, বর্তমানে ভূগর্ভস্থ এই কারাগারে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি আটক আছেন। তাদের মধ্যে অন্তত দুজন কোনো ধরনের অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই মাসের পর মাস বন্দী রয়েছেন। একজন পেশায় নার্স, যাকে হাসপাতালের পোশাক পরা অবস্থায় আটক করা হয়েছিল। অন্যজন তরুণ খাবার বিক্রেতা, যাকে ইসরায়েলি বাহিনী তল্লাশিচৌকি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

এই দুই ব্যক্তিকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভূগর্ভস্থ রাকেফেত কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরে পিসিএটিআইয়ের আইনজীবীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। আইনজীবীদের কাছে তারা জানিয়েছেন, সেখানে নিয়মিত মারধর, শারীরিক নির্যাতন এবং মানবিক অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে তাদের।

নিষ্ঠুর অতীত, ভয়াবহ বর্তমান

রাকেফেত কারাগার ইসরায়েল প্রথম চালু করেছিল ১৯৮০–এর দশকের শুরুর দিকে, সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীদের আটক রাখার জন্য। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই বন্দীদের ওপর অমানবিক আচরণের অভিযোগ ওঠে, এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ১৯৮৫ সালে কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েলের উগ্রপন্থী নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’ আবার এই কারাগারটি চালু করার নির্দেশ দেন। তার ভাষায়, সন্ত্রাসীদের জায়গা মাটির নিচেই।

রাকেফেতের কারাকক্ষ, ব্যায়ামের জায়গা, এমনকি আইনজীবীদের সাক্ষাৎ কক্ষ— সবকিছুই ভূগর্ভস্থ। ফলে বন্দীরা বছরের পর বছর সূর্যের আলো দেখতে পান না। তাদের ওপর মানসিক ও শারীরিক চাপ অবর্ণনীয়।

কারাগারের ভিতরের ভয়াবহ জীবন

পিসিএটিআইয়ের তথ্য অনুসারে, রাকেফেত মূলত কড়া নিরাপত্তার বন্দীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। শুরুতে প্রতিটি বন্দীর জন্য পৃথক কক্ষ ছিল, এবং ১৯৮৫ সালে বন্ধ হওয়ার সময় সেখানে ১৫ জন বন্দী ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১০০-তে দাঁড়িয়েছে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল আদালতে দোষী সাব্যস্ত ২৫০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়। এ ছাড়া গাজা থেকে আটক এক হাজার ৭০০ জন ফিলিস্তিনিকেও অভিযোগ ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মুক্তি পান রাকেফেত কারাগারে বন্দী থাকা তরুণ খাবার বিক্রেতা। তবে নার্সটি এখনো কারাগারে আছেন।

পিসিএটিআই বলছে, যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও গাজার বহু সাধারণ নাগরিক এখনো ইসরায়েলি কারাগারে আটক আছেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।

সাক্ষাৎকারে উন্মোচিত অন্ধকার

গত সেপ্টেম্বরে পিসিএটিআইয়ের দুই আইনজীবী— জেনান আবদু ও সাজা মিশেরকি বারানসি—রাকেফেতে বন্দী ওই দুজনের সঙ্গে দেখা করতে যান। তারা জানান, মুখোশ পরা সশস্ত্র প্রহরীরা তাদের মাটির নিচের কারাগারে নিয়ে যায়। ময়লা-আবর্জনায় ভরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে তারা যে কক্ষটিতে পৌঁছান, সেটি ছিল দুর্গন্ধে ভরা, পচা-পোকামাকড়ে আচ্ছন্ন। শৌচাগার ব্যবহারের অযোগ্য, আর দেয়ালে ঝুলছে নজরদারি ক্যামেরা— যা আইনগতভাবে মৌলিক গোপনীয়তার লঙ্ঘন।

প্রহরীরা আইনজীবীদের কড়া হুঁশিয়ারি দেয়—বন্দীদের সঙ্গে পরিবার বা গাজা যুদ্ধ নিয়ে কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাৎ বাতিল করা হবে।

জেনান আবদু বলেন, আমাদের প্রতি আচরণই যদি এত অপমানজনক হয়, তাহলে বন্দীদের অবস্থা কল্পনা করাই যায়। তিনি দেখেছেন, বন্দীদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মাথা নিচু করে হেঁটে আনা হয়। প্রহরীরা জোর করে তাদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখে।

আইনজীবী বারানসি বলেন, আমাদের মক্কেলদের কারো বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ নেই, তবু বিচারক ভিডিও শুনানিতে কয়েক সেকেন্ডেই আটকাদেশ অনুমোদন করেন। কোনো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি, প্রমাণ দেখানো হয়নি। শুধু বলা হয়— যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কারাগারে থাকবে।

বন্দীদের বর্ণনা ভয়াবহ— কক্ষে কোনো জানালা নেই, বাতাস চলাচলের পথ নেই। তিন-চারজনকে একসঙ্গে রাখা হয় ছোট্ট ঘরে। নিয়মিত মারধর, কুকুর দিয়ে ভয় দেখানো, খাবার না দেওয়া, পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থাকা—এসবই রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনে একবার নামমাত্র সময়ের জন্য কক্ষের বাইরে যেতে দেওয়া হয়, তাও মাটির নিচেই। প্রায় দুই দিন পরপর পাঁচ মিনিটের জন্য তাদের হাওয়া খেতে দেওয়া হয়। প্রতিদিন ভোরে প্রহরীরা বিছানা সরিয়ে নেয়, ফেরত দেয় গভীর রাতে— ফলে বন্দীদের ঘুমাতে হয় লোহার খাটে।

মানসিক ধ্বংস ও মানবিক লজ্জা

পিসিএটিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক তাল স্টেইনার বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতিটি কারাগারেই ফিলিস্তিনি বন্দীদের জন্য অমানবিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রাকেফেত একেবারেই আলাদা— এখানে বন্দীরা সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখে না। এর মানসিক প্রভাব ভয়ংকর। এটি দীর্ঘমেয়াদে মানবস্বাস্থ্যের জন্য মৃত্যুফাঁদের সমান।

তিনি আরো জানান, রাকেফেত কারাগার সম্পর্কে আগে কিছুই জানতেন না। বেন-গভির কারাগারটি পুনরায় চালুর নির্দেশ দেওয়ার পরই প্রথম সেখানে যেতে হয় তাদের। পিসিএটিআইয়ের আইনজীবীরা পুরোনো রেকর্ড, ইসরায়েলি কারাগার পরিষেবার সাবেক প্রধান রাফায়েল সুইসার-এর আত্মজীবনী ও আর্কাইভ ঘেঁটে জানতে পারেন, আশির দশকে তিনিও লিখেছিলেন—২৪ ঘণ্টা মাটির নিচে কাউকে বন্দী করে রাখা নির্মমতা ছাড়া আর কিছু নয়। যত বড় অপরাধীই হোক, এটি অমানবিক।

বন্দীদের কান্না, পরিবারের বেদনা

জেনান আবদু বলেন, আমি যাকে দেখেছি, সে ছিল মাত্র ১৮ বছর বয়সী এক খাবার বিক্রেতা। তাকে রাস্তায় তল্লাশিচৌকি থেকে তুলে আনা হয়েছিল। কথোপকথনের সময় তরুণটি জানতে চায়, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কি নিরাপদে সন্তান জন্ম দিয়েছেন? প্রশ্নটি শেষ করার আগেই প্রহরীরা কথোপকথন থামিয়ে দেয় এবং বন্দীকে নিয়ে যায়। আবদু জানান, লিফটের শব্দে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কারাগারটির আরো নিচে আরেকটি স্তর আছে।

অন্যদিকে নার্সটির বয়স ৩৪ বছর। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে হাসপাতালে কাজ করার সময় তাকে আটক করা হয়। 

আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধের সময় যেসব ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। ২০১৯ সালে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বলেছিল, আলোচনার স্বার্থে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ আটকে রাখা আইনসম্মত। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ইসরায়েল এখন জীবিত বন্দীদেরও একইভাবে ‘বিনিময়ের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

রাকেফেত কারাগারের বাস্তবতা— মাটির নিচে বন্দীদের সূর্যালোকহীন জীবন, নিঃশ্বাসহীন কক্ষ, নির্যাতন আর নিঃসঙ্গতা—মানবসভ্যতার বিবেককে নাড়া দেয়। পিসিএটিআই ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষায়, এটি শুধুমাত্র একটি কারাগার নয়; বরং মানবাধিকারের নামে গড়ে ওঠা আধুনিক বিশ্বের নৈতিক পরাজয়ের এক নীরব প্রতীক।

পিপলসনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --


CONTACT

ads@peoplenewsbd.com

কপ-৩০ সম্মেলন শুরু আজ : দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন জলবায়ুকর্মীরা কপ-৩০ সম্মেলন শুরু আজ : দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন জলবায়ুকর্মীরা মুন্সীগঞ্জে বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিতে যুবক নিহত, আহত এক মুন্সীগঞ্জে বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিতে যুবক নিহত, আহত এক গোপালগঞ্জে ট্রাকের পেছনে মোটরসাইকেলের ধাক্কা, নিহত ২ গোপালগঞ্জে ট্রাকের পেছনে মোটরসাইকেলের ধাক্কা, নিহত ২ সাতকানিয়ায় ছেলের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল বাবার সাতকানিয়ায় ছেলের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেল বাবার রাজধানীতে দুই বাসে আগুন রাজধানীতে দুই বাসে আগুন