জিনেদিন জিদানের সেই ‘বিখ্যাত’ ঢুস: কী ঘটেছিল সেদিন
প্রকাশ : ০৯-০৭-২০২৫ ১১:৫৭

ছবি : সংগৃহীত
ক্রীড়া ডেস্ক
বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ এবং কখনো কখনো তিক্ত মুহূর্ত। ২০০৬ সালের ৯ জুলাই, বার্লিনে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি ফুটবল ইতিহাসে চিরকাল মনে রাখা হবে। কিন্তু এই ম্যাচটি শুধু দুই দলের খেলার জন্য নয়, বরং একটি বিতর্কিত ঘটনার কারণে অনস্বীকার্যভাবে ফুটবল বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। সেটি হল জিনেদিন জিদান এবং মার্কো মাতেরাজ্জির মধ্যে সংঘটিত সেই পাগুলে কাণ্ড, যা কেবল সেদিনের ম্যাচই নয়, পুরো ফুটবল বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল।
সেই ঘটনার পর ১৯ বছর কেটে গেলেও, ফাইনালের ওই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত এখনো ফুটবলপ্রেমীদের মনে উজ্জ্বল। এ ঘটনার কারণেই ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালটি সর্বদা আলোচিত হয়ে থাকবে, তবে অন্য কোনো কারণ নয়, বরং এক অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আকস্মিক ঘটনার জন্য। খেলার সময় ১-১ সমতায় থাকা অবস্থায়, জিদান মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে ঢুস মারেন এবং সেই মুহূর্তেই ম্যাচের রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন।
এ ঘটনার পর মাতেরাজ্জি এবং জিদান দুজনেই একাধিকবার নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন এবং ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তাদের কথাগুলি ফুটবল ইতিহাসের একটি অত্যন্ত বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
জিদানের কথা: জিনেদিন জিদান একাধিকবার বলেছেন, মাতেরাজ্জি তাকে এমন কিছু অপমানজনক কথা বলেন, যা একজন মানুষ হিসেবে তিনি মেনে নিতে পারতেন না। জিদান বলেন, মাতেরাজ্জি আমাকে জার্সি ধরতে বললে, আমি তাকে বললাম, যদি সত্যিই তোমার জার্সি দরকার হয়, ম্যাচ শেষে আমি তোমাকে দিব। কিন্তু তারপরে সে কিছু বাজে কথা বলা শুরু করল, যা আমি সহ্য করতে পারিনি। আমি তো প্রথমেই মানুষ, তারপর ফুটবলার। আমি কোনো অবস্থাতেই আমার মা-বোন নিয়ে অপমান শুনতে পারব না।
জিদান স্বীকার করেছেন, ওই মুহূর্তে তার প্রতিক্রিয়া ভুল ছিল, কিন্তু তিনি আবারো জানিয়ে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি এই ধরনের কথা বলেছিল, সে-ই আসল দোষী। কোনো মানুষকে অপমান করা, বিশেষত আপনার মাকে বা বোনকে নিয়ে কিছু বাজে মন্তব্য করা, সেটা কখনোই সহ্য করা যায় না, জিদান বলেন।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বকাপের ফাইনালে, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মাত্র ১০ মিনিট আগে আমি এই ধরনের আচরণ করব? আমি জানি, আমার আচরণ সঠিক ছিল না, কিন্তু আমি এই পরিস্থিতিতে অনুতপ্ত নই। কারণ, যদি আমি অনুতপ্ত হই, তবে সেটা মানে হবে, মাতেরাজ্জি যা করেছে, সেটা সঠিক ছিল। আমি এটিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারব না।
মাতেরাজ্জির কথা: মার্কো মাতেরাজ্জি ঘটনার পর জানিয়েছিলেন, তিনি এমন কিছু বলতে চাননি যা জিদানকে এতটা উত্তেজিত করে তুলবে। তিনি বলেছিলেন, আমরা ম্যাচের প্রথমার্ধে কিছু সময় একে অপরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করেছিলাম। প্রথমবার আমি দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম, কিন্তু জিদান খারাপভাবে সেটার প্রতিক্রিয়া দেখাল। এরপর যখন জিদান আমাকে বলল, তোমার যদি আমার জার্সি দরকার হয়, ম্যাচের পরে এসে নিতে পারো। আমি তাকে বলেছিলাম, জার্সির চেয়ে তোমার বোনকেই আমার বেশি পছন্দ।
এটা একেবারে নির্বোধ এবং ভুল কথা ছিল, তবে মাতেরাজ্জি স্বীকার করেছেন, এমন কথার প্রতিক্রিয়া পাওয়া উচিত ছিল না। তিনি জানান, ফুটবল মাঠে এমন কিছু বাজে কথা রোজই শোনা যায়, কিন্তু আমি কখনোই কাউকে মায়ের বিষয়ে বাজে কথা বলিনি এবং আমি কখনোই এমন কিছু বলব না।
ফাইনাল ম্যাচের পর: ম্যাচের ১১০ মিনিটে, অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে, যখন ম্যাচের ফলাফল ১-১ সমতায় ছিল, তখন জিদান মাতেরাজ্জিকেৎ ঢুস মেরে লাল কার্ড দেখেন। এরপর ম্যাচ টাইব্রেকারে চলে যায়, যেখানে ইতালি ৫-৩ গোলে ফ্রান্সকে পরাজিত করে। সেই মুহূর্তে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।
প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা: এ ঘটনার পর বিভিন্ন পত্রিকা, সাংবাদিক এবং বিশ্লেষকরা নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক সেই সময় জিদানের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, জিদান একজন ভালো মনের মানুষ। তার প্রতিক্রিয়া ছিল এক ধরনের উসকানির ফল। ফরাসি জনগণের একটি জরিপে ৬১ শতাংশ মানুষ জিদানের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। তবে, ফরাসি পত্রিকা লা ফিগারো-এর প্রতি সমালোচনা করে জানায়, এটি একটি অগ্রহণযোগ্য এবং ঘৃণিত ঘটনা।
ফিফা পরে জানায়, যে রেফারির সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল এবং তাকে লাল কার্ড দেখানো উচিত ছিল। তবে ফিফা, মাতেরাজ্জিকে পাঁচ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা ও দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে, জিদানকে সাত হাজার ৫০০ সুইস ফ্রাঁ জরিমানা এবং তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যেহেতু জিদান তখনই অবসর নিয়েছিলেন, তাই তিনি নিষেধাজ্ঞা না পেয়ে পরিবর্তে তিন দিন কমিউনিটি সার্ভিস করেন।
২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালটি শুধু একটা খেলা ছিল না, এটি একটি স্মরণীয় অধ্যায়, যা ফুটবল ইতিহাসের একটি বিতর্কিত, কিন্তু একেবারে চিরকালীন মুহূর্ত হিসেবে রয়ে গেছে। কেউ এটিকে ভিলেন মাতেরাজ্জির কৌশল মনে করেন, আবার কেউ জিদানের মাথা গরম হওয়া এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক সমাপ্তি হিসেবেও দেখেন। তবে, ফুটবল ইতিহাসে এই ঘটনাটি চিরকাল স্মরণীয় থাকবে এবং একে নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com