টিলা কাটা ও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসতি দুটোই চলছে সিলেটে
প্রকাশ : ১২-০৭-২০২৫ ১১:২৮

ছবি : সংগৃহীত
সিলেট ব্যুরো
সিলেট শহরের কাছাকাছি অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর গ্রামটি ছোট ছোট টিলা দিয়ে ঘেরা। টিলাগুলোর পাদদেশে দেখা যায় বেশ কিছু বাড়িঘর, যার অধিকাংশই আধাপাকা এবং টিনের চাল যুক্ত। এসব বাড়িঘর নির্মাণ করতে গিয়ে এখানকার বাসিন্দারা টিলা কাটার কাজ করেছে— এটি কোনো অজানা বিষয় নয়। তবে, এর মাঝে রয়েছে এক অদৃশ্য বিপদ, যেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। স্থানীয় পরিবেশবিদরা জানান, টিলা কাটার প্রক্রিয়া এবং সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করার কারণে, এলাকার বাসিন্দারা অনেকটাই মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
এখানে বাস করা মানুষের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তারা প্রায়শই টিলার পাদদেশে গর্ত করে রেখে বৃষ্টির পানি জমাতে বাধ্য হন। এর ফলে, টিলার ভেতরে মাটি নরম হয়ে পড়ে, যা সহজে কাটা সম্ভব হয়। সেই কাটানো মাটি বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং পরে খালি জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এভাবে টিলা কাটার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার পরপরই এই এলাকাটি একটি বড় বিপদের দিকে এগোচ্ছে।
পরিবেশবিদরা এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সরব। তাদের মতে, যখন টিলার ভেতর পানি জমে, তখন মাটি নরম হয়ে ধসে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। বর্ষাকালে এই ধরনের ধসের ঘটনা প্রায়শই ঘটে, যার ফলে বাড়িঘরের ওপর মাটি পড়লে প্রাণহানির আশঙ্কা বাড়ে। এর ফলে সিলেটে গত সাড়ে তিন বছরে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মৃত্যুর কারণ টিলা ধস।
জাহাঙ্গীরনগর গ্রামটি সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ইউনিয়নে অবস্থিত। এখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত পরিবারগুলোর সংখ্যা অত্যধিক এবং দিন দিন বসতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখানে অনেক বাড়ি নির্মাণাধীন রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই জানাচ্ছেন, বৃষ্টির দিনগুলোতে তারা বাড়িতে থাকলেও রাতে ঘুমানোর সাহস পান না। রাতে টিলা ধসের ভয় তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ পরিবার রাতের বেলা অন্য কোথাও, যেমন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সফিকুর রহমান বলেন, জাহাঙ্গীরনগরে এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাহার ৫০০ ভোটার রয়েছে। তবে এখানে প্রতিদিন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা মাইকিং করে টিলা কাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। তবে বর্তমানে টিলা কাটা বন্ধ হলেও মাটি বিক্রি করার কাজ চলছে। তিনি আরো বলেন, আমরা যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রশাসনকেই এর মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এদিকে, পরিবেশবিদরা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসন আসলে টিলা কাটা বন্ধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না, বা নিলেও তা অব্যাহত থাকে না। তারা বলেন, যতক্ষণ না বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রশাসন চোখ বন্ধ করে থাকে। টিলার মাটি কাটার বিষয়টি প্রায়ই নজরদারি থেকে বাইরে চলে যায়, তবে মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান পরিচালিত হয়।
সিলেটের বিভিন্ন টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী মানুষদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তাদের বসবাসের মূল কারণ মূলত ভাড়া। সিলেটের অন্যান্য এলাকা থেকে এখানে ভাড়া অনেক কম, আর তাই নিম্ন আয়ের মানুষরা ঝুঁকি মেনে এই অঞ্চলে বসবাস করছেন। এক প্রভাবশালী চক্রও টিলার পাদদেশে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়াটিয়া হিসেবে ভূমিহীন মানুষদের কম টাকায় ভাড়া দিচ্ছে।
সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যেমন গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর, এবং কোম্পানীগঞ্জের কিছু অঞ্চলে টিলা এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে কয়েক হাজার মানুষ। তবে এসব পরিবারের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি, কারণ স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, আমাদের একটি জরিপ চলছে, তবে এখন পর্যন্ত কিছু তথ্য পাওয়া গেছে এবং আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
সিলেট জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানাচ্ছে, এখানে বর্তমানে ৩৮৬টি পরিবার টিলা বা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। কিন্তু তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, বর্তমানে সিলেটে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি বাসাবাড়ি রয়েছে যেগুলি ঝুঁকিপূর্ণ টিলা এলাকায় অবস্থিত। তবে আমাদের তরফ থেকে এসব এলাকা ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে গেছে। যেমন, গত ১ জুন গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ এলাকায় একটি টিলা ধসে ঘুমন্ত একটি পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০২২ সালের জুন মাসে সিলেট নগরীর মেজরটিলা এলাকায় এবং জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নে টিলা ধসের ঘটনা ঘটে, যাতে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেইভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই বলেন, ২০১৭ সালে আমরা একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছি সিলেটে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরো অনেক বেড়েছে, কারণ টিলা কাটার পরিমাণও বেড়েছে। এর ফলে, বর্ষাকালে ঝুঁকি আরো বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধা সরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারে না, যদি না বিশেষ পরিস্থিতিতে তা জরুরি হয় এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি থাকে। তবে সিলেটে কতগুলো টিলা কাটানো হয়েছে এবং এর কী প্রভাব পড়ছে, তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই।
অবশেষে, সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা জানান, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, এবং টিলা কাটা বন্ধের জন্য বিভিন্ন আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। গত কয়েক মাসে অভিযান চালিয়ে আমরা কয়েকজনকে জরিমানা করেছি।
এভাবে, সিলেটে টিলা কাটা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের সমস্যা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যাচ্ছে, যাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com