মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা, ৪৫ ধরনের ত্রুটি শনাক্ত
প্রকাশ : ০৩-১১-২০২৫ ১১:৩৪
ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে যাত্রা শুরু করে মেট্রোরেল। সম্প্রতি মেট্রোরেল লাইনের ফার্মগেট অংশে পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালাম নামের এক পথচারী নিহত হন। তারপর নতুন করে আলোচনায় আসে মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ইতিমধ্যে মেট্রোরেলে মোট ৪৫ ধরনের ত্রুটি শনাক্ত করেছে যার মধ্যে সংকেত, বৈদ্যুতিক, অবকাঠামো ও ট্রেন-সংক্রান্ত সমস্যাই প্রধান। চুক্তি শেষ হলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শকের অবহেলায় এসব ত্রুটি রয়ে গেছে, ফলে প্রায়ই মেট্রোরেল চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে এমন ত্রুটি প্রমাণ করে দুর্বল তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজগুলো যথাযথভাবে করেনি, কিংবা চুক্তি অনুসারে যতটুকু কাজ করার কথা ছিল, তা হয়নি।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ কাজে ১০ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি পেয়েছে কর্তৃপক্ষ। বৈদ্যুতিক কাজের মধ্যে ত্রুটি ও ঘাটতির সংখ্যা ১৬ ধরনের। উড়ালপথ ও অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত পুরকৌশল কাজে পাওয়া গেছে ১০ ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি। আর মেট্রোরেলের ট্রেন এবং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবস্থায় মোট ত্রুটি ও ঘাটতি পাওয়া গেছে নয় ধরনের।
ডিএমটিসিএলের ৬৩ পৃষ্ঠার একটি নথিতে ত্রুটি ও ঘাটতির বিষয়ে সবিস্তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেগুলো পূরণ করে দেওয়ার জন্য ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চিঠির পরও বেশির ভাগ ঘাটতি পূরণ করা হয়নি। কিছু ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার পরও এর পূর্ণাঙ্গ সমাধান হয়নি। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যে মানের মালামাল সরবরাহের কথা ছিল, তা দেননি ঠিকাদার।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ত্রুটি ও ঘাটতির কারণে মেট্রোরেলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। তবে চলাচলে বিঘ্ন ঘটা, বারবার মেরামত করাসহ নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে।
চুক্তি অনুসারে, নির্মাণকাজ শেষের দেড় বছর পর্যন্ত যেকোনো ত্রুটি ও ঘাটতি পূরণ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেই মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিএমটিসিএলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ চাইছে, ঠিকাদার আরও দুই বছর বিনা পয়সায় ত্রুটি ও ঘাটতি সারিয়ে দিক। এ জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বিগত বছরগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন আমলারা। আন্তর্জাতিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গত ফেব্রুয়ারিতে এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও হংকংয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলী ফারুক আহমেদকে। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের ত্রুটি ও ঘাটতি নিয়ে চিঠি লিখে যাচ্ছি; কিন্তু চাহিদামতো সমাধান পাইনি। তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পের ত্রুটি ও ঘাটতি নিয়ে বিশদ তদন্ত চলছে। সময় বাড়িয়ে ত্রুটি ও ঘাটতিগুলো সমাধান করতে হবে ঠিকাদার ও পরামর্শককে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, তারা মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনের অন্তত ৮৯ জায়গায় পানি প্রবেশের তথ্য পেয়েছে। এ ছাড়া কর্মীদের বিশ্রামাগারসহ কয়েকটি কক্ষ, লিফট ও এসকেলেটরে প্রবেশের জায়গায় পানি পড়ে।
স্টেশনের ছাদের ফাঁক এমনভাবে তৈরি করা যে বৃষ্টি হলে লাইনের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মেও পানি পড়ে। কনকোর্স হলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (এসি) পাশ দিয়ে পানি আসে।
মেট্রোরেলের ট্রেনের দরজা প্ল্যাটফর্মে সুনির্দিষ্ট জায়গায় থামার কথা। কিন্তু ঢাকার মেট্রোরেলে বেশির ভাগ স্টেশনে ট্রেন সুনির্দিষ্ট স্থানের কিছুটা আগে বা পরে থামছে। ট্রেন থামার সময় ঝাঁকিও হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, টিকিট কাটার যন্ত্র বা ভেন্ডিং মেশিন থেকে প্রতি মিনিটে পাঁচটি টিকিট কাটতে পারার কথা। প্রতি মিনিটে ৬০ জন যাত্রী প্রতি গেট দিয়ে বের হতে পারার কথা; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক বছরে ‘লোকাল কন্ট্রোল ইউনিট’ ১৩ বার বিকল হয়েছে, যার ফলে যাত্রীদের স্টেশন গেট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশে সমস্যা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আয়ের যে ব্যবস্থা, তা চাহিদামতো মানে সরবরাহ করা হয়নি। পুরোনো সংস্করণের কম্পিউটার দিয়ে কাজটি করা হচ্ছে।
ইলেকট্রনিক ব্রেক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বেশ কয়েকবার ঠিকমতো কাজ করেনি। এর ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে। সাতটি ট্রেনে ‘পাওয়ার বোর্ড কার্ড’ (ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ) বদলে দিয়েছে ঠিকাদার। বাকি ১৭টি ট্রেনে এখনো বদলানো হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, সব ট্রেনেই এটি বদলানো দরকার। এ ছাড়া ট্রেনের ব্রেক ব্যবস্থায় ৩০২টিতে সামান্য চিড় পাওয়া গেছে। বদলানোর পরও এই সমস্যা রয়ে গেছে।
কারিগরি কারণে অনেকবার মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখতে হয়েছে, কিংবা যাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি তালিকা করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। মেট্রোরেল ব্যবস্থায় ওরাকল ডেটাবেস সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হয়ে গেছে বলে ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, ডিএমটিসিএলের তৈরি বিভিন্ন কাজের ঘাটতি ও ত্রুটির করা তালিকায় বিয়ারিং প্যাডের সমস্যার বিষয়টি আগেই উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২৭৪টির মতো বিয়ারিং প্যাডে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বিচ্যুতি ধরা পড়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথ নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে; যা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি, বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষে। তারপরও ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে।
মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ আটটি ভাগে (প্যাকেজে) ঠিকাদারদের দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পুরো ব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ এবং নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন, যা বেশ কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত জোট। এর মূল নেতৃত্বে রয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই। এ ছাড়া আরও আছে নিপ্পন কোই ইন্ডিয়া, দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন, যুক্তরাজ্যের মট ম্যাগডোনাল্ড, মট ম্যাকডোনাল্ড ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস।
২০১৩ সালে এনকেডিএমকে পরামর্শক হিসেবে প্রায় এক হাজার ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। ঠিকাদারের কাজ ও পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং যথাযথ কাজ আদায় করার দায়িত্ব পরামর্শকের। তাদের কাছ থেকে পুরো কাজ বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব প্রকল্প পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের। এ জন্যই ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ ত্রুটি ও ঘাটতির বিষয়ে সরাসরি ঠিকাদারকে কিছু না বলে পরামর্শককে চিঠি দিয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে এনকেডিএমের হয়ে ভারপ্রাপ্ত দলনেতার দায়িত্বে রয়েছেন জাপানের তাকাউকি ফুজিতোমি।
২০২২ সালে মেট্রোরেল চালু হয়। ওই সময় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এম এ এন সিদ্দিক ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তার আট বছর কার্যকালেই মেট্রোরেলের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এসে তাকে সরিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাড পড়ে মানুষের মৃত্যু, স্থাপনার নানা ত্রুটি আর ঘাটতি দেখে এটা বলা যায়, আমরা বিপুল টাকা খরচ করে একটা অসম্পূর্ণ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পেয়েছি। এমনিতেই মেট্রোরেলের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বড় বিপদে পড়তে হবে। এর সঙ্গে যদি নতুন একটা অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে তো বড়ই বিপদ হবে।’
অধ্যাপক সামছুল হক আরো বলেন, ‘কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম বড় পরামর্শক সেবা ক্রয় করা হয়েছে। মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় আশপাশের দেশের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। ফলে ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনা পাব কেন? এর জন্য ঠিকাদার ও পরামর্শককে ক্ষতিপূরণের আওতায় আনতে হবে।’
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com