ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে
প্রকাশ : ১৩-০৭-২০২৫ ১২:২৩

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ ২০২৩ সালে যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, সেই স্মৃতি এখনো দেশের মানুষের মনে তাজা। ডেঙ্গু সংক্রমণ আবারো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা একলাফে গত পাঁচ মাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল চার হাজার ৩৪৫ এবং মারা গিয়েছিল ২৩ জন। কিন্তু জুন মাসে পরিস্থিতি একেবারে পরিবর্তিত হয়ে পাঁচ হাজার ৯৫১ জন আক্রান্ত এবং ১৯ জন মারা যান। জুলাই মাসের প্রথম ১০ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৭৩ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ডেঙ্গু সংক্রমণের বৃদ্ধি এখন শুধু একটি পরিসংখ্যানের বিষয় নয়, এটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য সংকেতও বটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা চলতে থাকলে আগামী আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু সংক্রমণ আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে, যেহেতু প্রতিবছর এই সময়েই ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। ডেঙ্গু পরিস্থিতির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বর্তমানে দেশের সাধারণ জনগণের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে যেখানে মাত্র এক হাজার ১৬১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল এবং ১০ জন মারা গিয়েছিল, সেখানে জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৯৫১ জনে এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে, এক সপ্তাহের মধ্যে তিন হাজার ৭৭৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ১২ জন মারা গেছেন। এই উল্লম্ফনটি ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বছর ছিল ২০২৩, যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭০৫ জন। এটি ছিল গত ২৩ বছরে সবচেয়ে বড় মহামারি। ওই বছর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকার ও বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রবণতা দেখে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে এই পরিস্থিতি ২০২৩ সালের থেকেও ভয়াবহ হতে পারে।
ডেঙ্গু সংক্রমণ শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, বরং দেশের প্রতিটি জেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের সূচক, বা 'ব্রেটো ইনডেক্স', ২০ এর ওপরে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি হলে, ওই এলাকা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এই গবেষণায় বরগুনা, বরিশাল, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর, মাদারীপুরসহ অন্তত ১১টি জেলা ডেঙ্গুর বিস্ফোরণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলে, তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে এবং এটি ২০২৩ সালের ভয়াবহ মহামারির থেকেও বড় সংকটের কারণ হতে পারে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহতার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল মে মাসের পরই। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, জুনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে, যা পরবর্তীতে আরো বাড়বে। তিনি জানান, তারা নিয়মিত ডেটার বিশ্লেষণ করে সংক্রমণের প্রবৃদ্ধির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এই পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন যথাযথভাবে কাজ করছে না এবং সাধারণ জনগণও ডেঙ্গুর প্রতি ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। অনেকেই জানেন না কোথায় মশা ডিম পাড়ে বা কীভাবে লার্ভা ধ্বংস করতে হয়, অথচ এই বিষয়গুলো মেনে চললে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ সম্ভব। তিনি আরো জানান, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে শহরাঞ্চলে মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তারের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও নাগরিক জীবনযাত্রার অভ্যাস পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বিস্তার ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অব্যবস্থাপনা, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি এবং পরিত্যক্ত স্থানে ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল তৈরি হচ্ছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো লার্ভা ধ্বংস করা। কিন্তু বহু এলাকাতেই পর্যাপ্ত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষা করা হচ্ছে না। পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলো জনবল সংকটে পড়েছে এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে লার্ভা ধ্বংসে সাফল্য অর্জন করতে পারছে না।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনও এডিস মশার বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টি, তাপমাত্রার ওঠানামা এবং আর্দ্রতা মশার জীবচক্রে সহায়তা করছে এবং ভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, যেখানে বৃষ্টি বা সাপ্লাইয়ের পানি সংগ্রহ করা হয় ছোট-বড় পাত্রে, তা দ্রুত মশার প্রজননস্থলে পরিণত হচ্ছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে শুধু একটি রোগ নয়, এটি জলবায়ু, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট, যার সমাধান জরুরি। জনস্বাস্থ্যবিদ এবং কীটতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, সরকারের উচিত ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ ঘোষণা করা। এই পরিস্থিতি যদি অনুধাবন না করা হয়, তবে এই সংকট আরো বড় আকার ধারণ করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. আবু জাফরও একই মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর ধরন বদলে গেছে এবং এটি সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য নতুন ধরনের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োজন।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com