পেঁয়াজ তেল সবজির দামে অস্বস্তি
প্রকাশ : ১৮-০৪-২০২৫ ১১:৫০

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
ঈদুল ফিতরের পর বাজারে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। পেঁয়াজের ভরা মৌসুম এখন। তারপরও কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। গত মঙ্গলবার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা করা হয়েছে।
সয়াবিনের বিকল্প পামতেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা। সবজির সরবরাহ কমায় প্রায় সব ধরনের সবজি বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এখনো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে চাল। তবে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে আলু, ডিম ও মুরগিসহ কয়েকটি পণ্যের দাম।
এদিকে বাজারে নির্ধারিত নতুন দরের তেল না এলেও দাম বাড়ার ঘোষণায় খুচরা ব্যবসায়ী অনেকে বোতলজাত পুরনো সয়াবিন তেল নতুন দামে বিক্রি করছেন।
ক্রেতারা বলছেন, বাজারে তদারকি না থাকায় ব্যসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। এখনই ব্যবস্থা না নিলে বাজারে অস্থিরতা বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ায় হঠাৎ পাইকারিতে দাম বেড়েছে। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আসে ফরিদপুর থেকে। ফরিদপুরে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় ঢাকার বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় প্রতি কেজি ভালো মানের পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। বাজারে নির্ধারিত নতুন দরের সয়াবিন তেল এখনো আসেনি।
বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট থাকায় অনেকে এই সুযোগ নিচ্ছেন। পুরনো বোতলজাত তেল বিক্রি করছেন নতুন দামে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) রাজধানীর খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪৬ টাকায়।
মগবাজারে খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা আলম মিয়া বলেন, এখন পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ নেই। কৃষকরা পেঁয়াজ উৎপাদন করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন। এই সুযোগে মুনাফালোভী কিছু বড় ব্যবসায়ীরা মজুদ বাড়িয়ে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন।
রামপুরা বাজারের বিক্রেতা বেলাল হোসেন বলেন, ঈদের পর প্রায় প্রতিদিন পাইকারি বাজারে একটু একটু করে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। সব হিসাবে নিলে, গত দুই সপ্তাহে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ২০ টাকা বেড়েছে। এখন পাইকারিতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকায়।
হাজীপাড়া বাজারে এক্তাদুল চৌধুরী নামের একজন ক্রেতা বলেন, পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা ও তেলের দাম ১৪ টাকা বেড়েছে। তাহলে একটি পরিবারের প্রায় ২০০ টাকা খরচ বাড়ছে এই দুটি পণ্যের পেছনেই। তাহলে আমাদের মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষ কীভাবে খরচ সমন্বয় করবে?
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ কমেছে ঠিকই, তবে দাম বাড়ার হার অস্বাভাবিক। সিন্ডিকেটও সক্রিয় রয়েছে, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটছে।
পুরনো বোতলজাত তেল নতুন দামে বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী বলছেন, দাম বাড়ানোর ঘোষণার কয়েক দিন আগে থেকে ভোজ্য তেল সরবরাহকারী কোম্পানির ডিলাররা আগের দামে আর তাদের কমিশন দিচ্ছিলেন না। ডিলাররা কমিশন ছাড়াই বোতলের গায়ের দামেই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তেল বিক্রি করছেন। ফলে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে বোতলের গায়ের আগের দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
বাজারে নতুন করে পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। বাড্ডায় শফিকুল ইসলাম নামের একজন ক্রেতা বলেন, নতুন করে কারসাজি শুরু হয়েছে। একদিকে কৃষক পেঁয়াজের দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তাদের বাড়তি দামে পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। লাভ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। পাইকারি, মোকাম ও আড়তে এখন থেকে নজরদারি না বাড়ালে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যাবে।
শুক্রবার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে এখন ঝিঙা ও লাউ দামি সবজি। ঝিঙা প্রতি কেজি মানভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, প্রতি পিস লাউ ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বেগুন মানভেদে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা, করলা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, পটোল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা, শজনে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০ টাকা, টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, গাজর ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা, পেঁপে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, দেশি শসা ৮০ টাকা ও প্রতি পিস চালকুমড়া ৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
তবে এখন মাংসের বাজারে অনেকটা স্বস্তি আছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে বাড়তে থাকে মাংসের দাম। তখন প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২৩০ টাকা দরে। একইভাবে সোনালি জাতের মুরগির কেজি বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকা দরে। শুক্রবার প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৮০ এবং সোনালি জাতের মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একইভাবে কিছুটা দর কমেছে গরুর মাংসের। ঈদের আগে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকায়। এখন দর কমে কেজি ৭৫০ টাকায় মিলছে।
বেশ কয়েক সপ্তাহ নিম্নমুখী ডিমের দরে তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দামে। মাসখানেক ধরেই এই দামের আশপাশে রয়েছে ডিমের দর।
এদিকে মাছের দামও বাড়তি। বাজারে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে দেশি জাতের মাছের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে চিংড়ি, শিং, টেংরা, শোল ও পুঁটির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। দেশি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০০–৯০০ টাকায়; যা গত সপ্তাহে ছিল ৭০০–৮৫০ টাকা। চাষের চিংড়ির দামও বেড়ে হয়েছে ৬৫০–৭৫০ টাকা। টেংরা ও শিং মাছ ৬০০–৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; আগে যা ছিল ৫০০–৬০০ টাকার মধ্যে। শোল মাছের দাম বেড়ে ৮৫০ টাকায় পৌঁছেছে; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭৫০–৮০০ টাকা। রুই ও কাতলা মাছেও বেড়েছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। তবে তেলাপিয়া ও পাঙাশের মতো সাধারণ মাছের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে—২০০–২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজ বাজারে দেখলাম সবজির বাজার খুব চড়া। এত দাম দিয়ে সবজি তো সাধারণ মানুষ কিনে খেতে পারে না। এজন্য দরকার সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা, কী কারণে সবজির দাম বাড়ছে, কারা বাড়াচ্ছে এসব বিষয় তদারকি করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো যে যার মতো করে সবজির দাম বাড়িয়ে রাখছে। বাজারে দেখলাম সবচেয়ে বেশি দামি সবজি হচ্ছে কাঁকরোল আর বেগুন। এগুলো ১৪০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাকি সবজিগুলোর দামও ৭০ থেকে ৮০ টাকার ঘরে।
মালিবাগ বাজারের আরেক ক্রেতা এরশাদ আলী বলেন, বাজারে সবজির দাম বাড়তি। বিশেষ করে ঈদের পর থেকে প্রতিদিনই সবজির দাম বেড়েই চলছে। এখানে ৭০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। আর অন্যান্য সবজির দাম তো সেঞ্চুরি পেরিয়েছে। এত দামি সবজি আমাদের মতো সাধারণ করে তাদের কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবজি দাম বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে সেগুনবাগিচার সবজি বিক্রেতা তৈয়ব আলী বলেন, বাজারে এখন সবজির সরবরাহ কম। মূলত মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে এসব সবজি বাজারে সরবরাহ কম, সে কারণেই দাম বাড়তি যাচ্ছে। শীতের সবজি শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাজারে আস্তে আস্তে দাম বাড়তে থাকে। এখন নতুন করে, এই মৌসুমের সবজি উঠবে কিছুদিন পর। নতুন সবজি উঠতে শুরু করলে সবজির দাম আবার কিছুটা কমে আসবে।
সবজির দামের পার্থক্যের কারণ জানিয়ে কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, রাজধানীর অন্যান্য বাজারের তুলনায় কারওয়ান বাজারের সবজির দাম কিছুটা কম। অন্য বাজারে যদি কোনো সবজির দাম খুচরা ৮০ টাকা হয়, তাহলে তা কারওয়ান বাজারে ৬০ টাকা। আসলে যারা এখান থেকে সবজি কিনে নিয়ে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন, তাদের পরিবহন খরচ, রাস্তা খরচ,দোকান ভাড়া, কর্মচারী খরচ সব মিলিয়ে তারা কিছুটা বাড়তি দামে বিক্রি করেন। তবু ঈদের পর থেকে সব ধরনের সবজির দাম আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন সবজির শেষ সময়ের মৌসুম, নতুন করে মৌসুম শুরু হলে সবজি বাজারে আসতে শুরু করবে, তখন ধীরে ধীরে সবজির দাম কমে আসবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com