বিএনপিতে শুদ্ধি অভিযানের পরও দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে ত্রাহি অবস্থা
প্রকাশ : ১৩-০৭-২০২৫ ১৬:৪৯

ছবি: সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক মাঠে শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও সাম্প্রতিক সময়ে বড় সংকটের সম্মুখীন। দলটির ভেতরে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত রয়েছে কিংবা প্রবেশ করেছে। দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বারবার সতর্কবার্তা দিয়েছেন এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবু দলের নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি দলটির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে হচ্ছে, যাতে দলীয় নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা যায়। তবে বিএনপির অভ্যন্তরে এই দুর্বৃত্ত সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িত— যে অপরাধগুলো অন্তর্ভুক্ত চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডসহ আরো নানা সামাজিক অস্থিরতার বিষয়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে দেশব্যাপী ৩৪৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৮৭ জন নিহত ও তিন হাজার ৯২৯ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার মধ্যে ৩২৩টির সঙ্গে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো জড়িত ছিল এবং এই নিহতদের মধ্যে অন্তত ৭৭ জন এবং আহতদের মধ্যে তিন হাজার ৬৫৩ জন বিএনপি কর্মী।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে অন্তত ৫২৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ৭৯ জন নিহত ও চার হাজার ১২৪ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
এর মধ্যে ৩০২টি ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঘটেছে, যেখানে দুই হাজার ৮৩৪ জন আহত ও ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ১৪০টির বেশি ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য দলের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটনাই স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার, প্রতিশোধ, দলীয় কমিটি নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও জমি বা সম্পত্তি দখল সংক্রান্ত।
মানবাধিকার সংস্থা আসকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তত ৪০৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ও এক হাজার ১০৫ জন আহত হয়েছেন।
এই সহিংসতার মধ্যে দলীয় আভ্যন্তরীণ কোন্দলও রয়েছে, যা রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল সম্প্রতি তাদের পাঁচ সদস্যকে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কৃত এই সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যায় জড়িত ছিলেন। সোহাগকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল) সামনে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভাঙারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এই ঘটনার ফলে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে লালমনিরহাটে একটি থানায় হামলা, ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় এক নারীকে ধর্ষণ, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লাঞ্ছিত করা এবং ঢাকার একটি রেস্তোরাঁ ও বারে দুই নারীকে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনারও তীব্র সমালোচনা হয়েছে। এসব ঘটনা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে; যা দলের জন্য আরো বড় রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
লালমনিরহাটে বিএনপি কর্মীরা পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে মোবাইল কোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত দুইজনকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। পরে পাটগ্রাম পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও এক সাবেক উপজেলা বিএনপি সদস্যকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। পাটগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকার রহমান স্বীকার করেছেন, দলীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। তিনি বলেন, বিএনপি বড় দল, আমরা বলতে পারি না যে এখানে সবাই নির্দোষ, সবাই ভালো। আমরা জেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার নির্দেশ বারংবার দিচ্ছি। তারপরও অনেকে সেসব নির্দেশ লঙ্ঘন করে।
ভোলায় ধর্ষণের ঘটনায় বিএনপি যথাযথ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু দলটির ভোলা জেলা শাখার সদস্য সচিব রইসুল আলম বলেন, দল কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় নিতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা এসব ঘটনা ঘটাতে কোনোভাবেই উৎসাহ দিচ্ছি না। একটি বড় দলে কিছু খারাপ মানুষ থাকবেই। তাদের অপরাধের জন্য পুরো দলকে দায়ী করা যায় না।
গত বছর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা একের পর এক সহিংস এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি দাবি করেছে, তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকে শুরু করে তৃণমূল কর্মী পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি সদস্যকে বহিষ্কার করেছে, যাতে দলটির শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি যথেষ্ট পদক্ষেপ নয় এবং দলটি আরো কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, এসব ঘটনার জন্য কেবলমাত্র বিএনপিই দায়ী নয়। দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও এর জন্য উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে দেখছি। তিনি বলেন, দল কঠোর অবস্থানে রয়েছে, কিন্তু এসব ঘটনায় যারা সরাসরি জড়িত, শুধুমাত্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেসব স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে এসব কর্মকাণ্ড ঘটছে, তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটি কেবল বিএনপির সমস্যা নয়। সব বড় রাজনৈতিক দলের অবস্থা কমবেশি একই রকম। যে দলই ক্ষমতায় থাকে বা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকে, সেই দলের আশপাশে একদল দুর্বৃত্ত ভিড় জমায়। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়, বরং এটি সব দলেরই অন্তর্নিহিত সমস্যা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, তার দল যেকোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িত সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন থেকে এক ভার্চুয়াল ভাষণে তিনি বলেন, বিএনপি একমাত্র দল যারা কোনো ভুল অস্বীকারে থাকে না। আমাদের দলের কেউ যদি অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।
এর কিছুদিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারি এক দলীয় বৈঠকে তিনি নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ওই সভায় অন্তত ১০৫ জন নেতা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও টেন্ডার কারচুপির মতো চলমান সমস্যাগুলি নিয়ে কথা বলেন। তবে, এসব সতর্কবার্তা দলের নেতাকর্মীদের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, তারেক রহমান দায়িত্ব নিয়েছেন এবং দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু দূরত্ব একটি বড় বিষয়। তিনি দূর থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, তারেক রহমান তার ভাষণে কঠোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কিন্তু, যদি তিনি দেশে থাকতেন এবং সরাসরি দলীয় শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, তাহলে এই ধরনের ঘটনা কম হতো। তিনি আরো বলেন, সরাসরি যোগাযোগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতাকর্মীদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। এটা সঠিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়তা করে। আমি বলব না যে তাদের দলীয় শৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু এত বড় একটি সংগঠন পরিচালনা করা মোটেই সহজ কাজ না। মজিবুর সতর্ক করেন, যদি এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে তা জনআস্থার হানি হবে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছি। এর মাধ্যমে জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত দলের ভেতরে থাকা দুর্বৃত্তদের বাদ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলীয় পর্যায়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে দলের প্রতিটি সদস্যের বিষয়ে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় এবং যারা অসদাচরণে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা যায়। এজন্য তারা তৃণমূল পর্যায় থেকে জরিপ পরিচালনা করছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com