ভেনিসে ইতিহাস গড়লেন বাঙালি তরুণী অনুপূর্ণা রায়
প্রকাশ : ১০-০৯-২০২৫ ১২:২৬

ছবি : সংগৃহীত
বিনোদন ডেস্ক
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার নারায়ণপুর গ্রামের এক তরুণী। আইটি খাতে চাকরি করতেন।পরে ছেড়ে দিয়ে বেছে নিলেন অন্য পথ— ক্যামেরা, গল্প ও সিনেমা। সেই পথ পাড়ি দিয়ে অনুপূর্ণা রায় পৌঁছেছেন ইতালির ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানেই নিজের প্রথম পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সংস অব ফরগটেন ট্রিজ’-এর জন্য তিনি জিতে নিয়েছেন অরিজ্জন্তি বিভাগে সেরা পরিচালকের পুরস্কার। এই প্রথম এ বিভাগে পুরস্কার জিতলেন কোনো ভারতীয় নির্মাতা।
‘কতবার ধন্যবাদ বলেছি, এখন আর গুনতে পারছি না!’ পুরস্কার জেতার পর ভেনিস থেকে দ্য হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান অনুপূর্ণা। ভেনিসে পুরস্কার জয়ের পর মঞ্চে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে অন্নপূর্ণা এই সম্মান উৎসর্গ করেন পুরো ভারতবাসীকেই।
তিনি বলেন, ‘এই চলচ্চিত্র সেসব নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, যাদের কণ্ঠস্বর চেপে রাখা হয়েছে, যাদের উপেক্ষা করা হয়েছে ও যাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আশা করি, এই জয় আরো অনেক নারীর কণ্ঠকে শক্তি জোগাবে এবং আরো অনেক গল্পকে সামনে আনবে।’ নিজের বক্তব্যে তিনি গাজায় ইসরায়েলি হামলারও নিন্দা জানান।
নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপের সহায়তায় তৈরি এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন নাজ শেখ ও সুমি বাঘেল। প্রযোজক বিবাংশু রায়, রোমিল মোদি ও রঞ্জন সিং। মুম্বাই শহরে দুই নারীর জীবন ও তাদের অদৃশ্য যোগসূত্রের গল্পই সিনেমার মূল সুর।
২০২২ সাল পর্যন্ত অনুপূর্ণা ছিলেন দিল্লি আর মুম্বাইয়ে আইটি চাকরিজীবী। সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দেন। একসময় একসঙ্গে দুই থেকে তিনটি কাজ সামলালেও মনে মনে জানতেন, তিনি সিনেমা বানাবেন। কিন্তু গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশে বিষয়টি সহজ ছিল না। ‘আমার মা–বাবা তো হতভম্ব। সবাই বললেন, পুরো গ্রাম রাগ করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মেনে নিলেন,’ বলেন তিনি।
মুম্বাইয়ে নতুন জীবন শুরু করেন অনুপূর্ণা। আজাদ নগরের ভাড়া ফ্ল্যাটেই লেখেন ছবির চিত্রনাট্য, আর সেখানেই চলত শুটিং। অভিনেত্রীরা তিন মাস একেবারে তার সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন। ‘সিনেমা বানানোর চেয়ে মনে হতো আমরা স্মৃতি তৈরি করছি। রান্না করতাম, শুটিং করতাম ও চিৎকার করতাম। সেই স্মৃতিই আজ ভেনিসের মঞ্চে আলো ছড়িয়েছে,’ বলেন এই বাঙালি তরুণী।
ব্যক্তিগতভাবে এই অর্জন অনুপূর্ণাকে বিনয়ী করলেও দায়িত্ব বাড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘অনুরাগ স্যার বলেছেন, পুরস্কার মানে দায়িত্ব। আমাকে আরো জরুরি গল্প বলতে হবে, আরো ভালো হতে হবে।’
সম্প্রতি কানের সাফল্যের পর ভেনিসেও ভারতীয় নারী পরিচালকদের জয়গান। অনুপূর্ণা স্পষ্ট বলেন, ‘আমি পায়েল কাপাডিয়াকে খুব শ্রদ্ধা করি। প্রেরণা পাই কিরণ রাও, জোয়া আখতার, রীমা দাশ, মীরা নায়ারের কাছ থেকেও। তারা পথ না বানালে আমিও আসতে পারতাম না।’
ভেনিস উৎসবের মঞ্চে প্রথমবার উঠতেই পেয়েছেন সাত মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে অভিবাদন। আলো জ্বলজ্বল করছিল মোবাইল ফোনে। ‘ওই মুহূর্তটাই আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। আজাদ নগরের ছোট্ট ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে আমরা গিয়েছি বিশ্বমঞ্চে,’ বলেন অনুপূর্ণা।
আজ পুরুলিয়ার সেই নারায়ণপুর গ্রাম নিশ্চয়ই গর্বিত। অনুপূর্ণার কথায়, ‘আমি জানি না, ওরা কতটা বোঝে। তবে নিশ্চিত, তারা খুশি হবে। শেষবার সেখানে গিয়েছিলাম ১০ বছর আগে। এবার ফিরব অন্য রকম জয় নিয়ে।’
‘সংস অব ফরগটেন ট্রিজ’ সিনেমায় নাজ শেখ অভিনীত থুয়া একজন নবীন অভিনেত্রী, সংসার চালাতে মাঝেমধ্যে যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করেন। সুমি বাঘেলের স্বেতা কাজ করেন কল সেন্টারে, বিয়ে বাজারে খুঁজছেন জীবনসঙ্গী। শহরের উন্মত্ত ভিড়ে দুজনই নিঃসঙ্গ ও আহত, তবু তারা একে অপরের কাছে খুঁজে পান আশ্রয়। স্বেতা প্রথমবার শহরে এসে সমুদ্র দেখতে চাইলেও থুয়া তাকে মৃদু হাসিতে বলেন, ‘এতটা সুন্দরও নয়।’
সমালোচকেরা বলছেন, অনুপূর্ণার ক্যামেরা লিরিক্যাল নয়; বরং স্থিরতায় ভরা। লম্বা শট আর সংযত বর্ণনায় তিনি নির্মাণ করেছেন নারীদের টিকে থাকার এক বেদনাদায়ক ছবি। ছবির নামের প্রেরণা এসেছে আসাম ও অরুণাচলের হলংগাছ থেকে। থুয়ার স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে শৈশবের বন্ধু ঝুম্পার নাম; বাল্যবিবাহের পর যে হারিয়ে গিয়েছিল। বাস্তবে অনুপূর্ণার এক সহপাঠী ছিল ঝুমা, যার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে যায়। প্রথমে অন্নপূর্ণা তাকে খুঁজে বের করার জন্য প্রামাণ্যচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিগত শোকই সিনেমার গল্পে রূপ পেয়েছে।
সিনেমায় ব্যবহৃত এই গল্পে লাল রং যেন মুক্তি ও অস্তিত্বের প্রতীক। থুয়ার লাল শাড়ি, নখে লাল রং— বিশেষত শেষ দৃশ্য দর্শকের মনে থেকে যাবে স্বাধীনতা আর আনন্দের ক্ষুদ্র প্রতীক হয়ে। অন্নপূর্ণা স্পষ্ট করে বলেননি থুয়া ও স্বেতার সম্পর্ক বন্ধুত্বের বাইরে গড়ায় কি না। তার গল্পে কিছু না বলাই যেন হয়ে ওঠে সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। আর শহরের কষ্টকর জীবনের ফাঁকেই হলংগাছের দোল খাওয়ার দৃশ্য এনে দেয় কবিতার স্পর্শ।
সমালোচকেরা বলছেন, এই সিনেমার কিছু সংলাপ আরোপিত মনে হলেও প্রধান অভিনেতাদের অভিনয় ছবিকে এগিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ভূষণ শিম্পি জমিদারের শিকারি চরিত্রে ভয়ংকরভাবে বিশ্বাসযোগ্য। তিনি যেন প্রতিদিনের জীবনে নারীদের ওপর চলতে থাকা অমানবিক নিপীড়নের প্রতীক। আরেক দৃশ্যে দেখা যায়, কল সেন্টারের গ্রাহক স্বেতাকে বলে, সে পণ্য কিনবে কেবল তখনই, যদি সে প্রতিদিন ফোনে কথা বলে। এমন হয়রানি এখন সর্বজনীন ও রুটিনের মতো।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com