১৩ নভেম্বরকে ঘিরে উত্তাপ, সতর্ক সরকার
প্রকাশ : ১১-১১-২০২৫ ১০:৪৬
ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী পরশু ১৩ নভেম্বরকে ঘিরে দেশজুড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ টহল জোরদার করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, ফলে নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে— যে কোনো বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতার চেষ্টা কঠোর হাতে দমন করা হবে। একই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে গুজব, উসকানিমূলক প্রচারণা ও বিভ্রান্তি ঠেকাতে সাইবার নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সর্বোপরি, ১৩ নভেম্বরকে ঘিরে সম্ভাব্য সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার এখন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।
এদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে, যা কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বেড়েছে।
গত শনিবার রাত থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে গ্রেপ্তার অভিযান বাড়িয়েছে পুলিশ। সোমবার থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে বাড়ানো হয় পুলিশের টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি।
এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, সরকারি স্থাপনা, দলীয় কার্যালয় ও পরিবহন টার্মিনালে মোতায়েন থাকছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বসানো হচ্ছে বাড়তি চেকপোস্ট। একই সঙ্গে সাইবার ইউনিটও সক্রিয় আছে, যাতে সামাজিক মাধ্যমে গুজব বা উস্কানিমূলক পোস্ট শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চলাচল, যোগাযোগ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত বার্তাগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
অবশ্য এর মাঝেও গত কিছুদিন রাজধানীতে নাশকতার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সোমবার ভোর থেকে সারাদিন রাজধানীতে অন্তত তিন বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। সাতটির মতো ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। আজ মঙ্গলবারও একাধিক স্থানে বাস পোড়ানোর খবর আসছে। ময়মনসিংহে বাসে থাকা চালক পুড়ে মারা গেছেন।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে না নিলে আজ মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীতে জনসভা থেকে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা আট দল। তবে এদিন যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে হবে, তা ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করবেন। এদিন ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে পলাতক অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
এ কর্মসূচি ঘিরে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। শনিবার রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিশেষ মতবিনিময় সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ নানাভাবে দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চালানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক মাধ্যমে ঢাকা লকডাউন কর্মসূচির নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব অপতৎপরতা দেখে জেলা পর্যায় থেকে নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারে, সে ব্যাপারে প্রতিটি জেলার পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। চেকপোস্ট, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
গত রবিবার দেশের অন্তত ১০টি জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে শনিবার তারা পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নির্দেশনা পেয়েছেন। অভিযানের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চেকপোস্টের ওপর। জেলা থেকে যাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকায় যেতে না পারেন, সেজন্য সোমবার থেকে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়। বিশেষ করে জেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে কঠোর নজরদারি থাকছে।
ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেআইনি কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় গিয়ে অবস্থান করতে পারে। এটা ঠেকাতে বিভিন্ন মেস, হোস্টেল ও আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া নজরদারি থাকছে ঝটিকা মিছিলের দিকে। মিছিল বের হলেই ছত্রভঙ্গ এবং সবাইকে আটক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই লকডাউন কর্মসূচি কেন্দ্র করে ঢাকায় রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ‘লকডাউন’ ডাকা দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে তাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলো।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে বৈঠক: আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল আজ মঙ্গলবার। কিন্তু ১৩ নভেম্বরের ঢাকা লকডাউনকে সামনে রেখে গত রোববার বিকেলেই সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দীর্ঘ সময় ১৩ নভেম্বরের কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ৬৪ জেলার এসপি, থানার ওসি ও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে কেউ যাতে বিশৃঙ্খল কার্যক্রম চালাতে না পারে, সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ হুটহাট করে যাতে কোথাও মিছিল-মিটিং করতে না পারে, জানমালের ক্ষতি করতে না পারে, সে বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, সামাজিক মাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা নজরে এসেছে। এসব বিষয়ে পুলিশি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা সতর্ক আছি। এ নিয়ে নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা আছে। অবৈধ কর্মকাণ্ড, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে কোনো শঙ্কা নেই। ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ নিয়ে সরকার শঙ্কিত নয়। কারণ, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৫০ শতাংশ সদস্যকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত যে তথ্য ছড়িয়েছে সেটা গুজব, এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সরকার প্রস্তুত আছে। জনগণের জানমাল রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা হতে দেওয়া হবে না।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com