অর্থবছরের ১০ মাসে রাজস্ব খাতে ঘাটতি ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি
প্রকাশ : ২৬-০৫-২০২৫ ১২:৫৫

ছবি : সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে। এ সময়ের মধ্যে মোট রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা; যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য প্রবৃদ্ধি থাকলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। রাজস্ব আদায়ে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র তিন দশমিক ২৪ শতাংশ। আয়কর, মূসক (ভ্যাট) বা শুল্ক— কোনো খাতেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।
এ অবস্থায় এনবিআর বিলুপ্ত করে নতুন দুটি বিভাগ— রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ— গঠনের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তাদের টানা আন্দোলন এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতি ও রাজস্ব খাত-সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল তিন লাখ ৫৮ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। বাস্তবে আদায় হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা কম। যদিও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কিছুটা বেশি ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আদায় হয়েছিল দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
বিভিন্ন কর খাত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো খাতেই এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। আয়কর ও করপোরেট ট্যাক্স মিলে সরাসরি কর খাতে এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে মাত্র ৯৪ হাজার ৯৩৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৭৪১ কোটি টাকারও বেশি। যদিও এই খাতে গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে চার দশমিক ৪৫ শতাংশ, তখন আদায় হয়েছিল ৯০ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা।
স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট খাতেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ২৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা, বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ঠিক এই পরিমাণই, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির পুরোটাই এসেছে এপ্রিলে কিছুটা বৃদ্ধির কারণে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা দেখা গেছে আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে শুল্ক আদায়ে। যেখানে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ এক হাজার ৬৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৮১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৮২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, ফলে চলতি অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক— এক দশমিক ৩৬ শতাংশ।
এপ্রিল মাস এককভাবে বিবেচনা করলেও দেখা যাচ্ছে, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। ওই মাসে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি ৫২ লাখ টাকা, আর আদায় হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধুমাত্র এপ্রিলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তবে গত বছরের এপ্রিলে আদায় হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৫০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, সেক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাত দশমিক ৪০ শতাংশ।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মাঝপথে এসে রাজস্ব আদায়ের গতি দেখে সরকার তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনে। তবু আদায়ের বর্তমান ধারা দেখে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না।
রাজস্ব ঘাটতির পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতি-সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত, বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক চাপে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে কর আদায়ে। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণের ব্যয়ক্ষমতা সীমিত হয়েছে, ফলে ভোক্তা পর্যায়ে কর আদায় কমেছে। তৃতীয়ত, চলতি মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টানা আন্দোলনের ফলে কাস্টমস ও ভ্যাটসহ অনেক দপ্তরে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এই কর্মবিরতির প্রভাব শুধু রাজস্ব ঘাটতি নয়, আমদানি-রপ্তানির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থবছরের বাকি দুই মাসে যদি এ অবস্থা চলতে থাকে, তবে রাজস্ব ঘাটতি ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে সরকারের চলমান প্রকল্প বাস্তবায়ন, বেতন-ভাতা প্রদান ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়নের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ কিংবা বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না থাকলে ভবিষ্যতের বাজেট বাস্তবায়ন এবং ঋণ পরিশোধে দেশের সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়বে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও বাধা সৃষ্টি হতে পারে। এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার, কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা— এই তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার না দিলে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে তারা মত দেন।
রাজস্ব ব্যবস্থাকে কার্যকর ও দক্ষ করতে হলে শুধু রাজস্ব কর্মকর্তাদের আন্দোলন বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বরং একটি স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক রাজস্ব নীতি গ্রহণ এবং প্রয়োগের উপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি করজালের আওতা বাড়িয়ে কর প্রদানকারীদের আস্থা ফেরানো ও উৎসাহিত করনীতি গ্রহণ করাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com