চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অচলাবস্থা
প্রকাশ : ২৬-০৫-২০২৫ ১২:০৮

ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রাম ব্যুরো
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে চলমান আন্দোলনের ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে চরম অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ে দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রতিষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটায় প্রতিদিন দুইশ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। রবিবার (২৫ মে) সারাদিন কাস্টম কর্মকর্তারা অফিসে উপস্থিত থাকলেও শুল্কায়নসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। কেবল বিকেল পাঁচটার পর সামান্য পরিমাণে কাজ শুরু হলেও তা ছিল একেবারেই সীমিত।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের এই অচলাবস্থার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে। প্রতিদিন গড়ে চার হাজার কনটেইনার খালাস হলেও রবিবার খালাস হয়েছে তার অর্ধেকেরও কম। ফলে বন্দরে তৈরি হয়েছে কনটেইনার জট। রবিবার পর্যন্ত বন্দরে জমে থাকা কনটেইনারের সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৩ হাজারে, যেখানে কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৪৫ হাজার টিইইউস। ফলে বন্দরের কার্যক্রম প্রায় সীমায় পৌঁছে গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দরের মোট ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার টিইইউস হলেও পরিচালনাগত কারণে অন্তত আট হাজার টিইইউস খালি রাখতে হয়। সাধারণ সময়ে বন্দরে গড়ে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার কনটেইনার থাকে। কিন্তু কাস্টমস ও শ্রমিকদের একাধিক কর্মসূচির কারণে গত তিন মাসে ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দেয়। সর্বশেষ ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ফলে কনটেইনার সংখ্যা বেড়ে ৪৩ হাজার ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বন্দরের বাইরে আরো ১৮টি জাহাজ পণ্য বোঝাই অবস্থায় সাগরে অপেক্ষমাণ রয়েছে, যেগুলোর কনটেইনার খালাস সম্ভব হচ্ছে না জায়গার অভাবে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি নির্ভর শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্প। কারখানাগুলো সময়মতো কাঁচামাল না পাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ফলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য রপ্তানি করাও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এবং বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ঈদের আগে এমন অচলাবস্থা আমাদের জন্য বড় ধরণের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা সময়মতো কাঁচামাল পাচ্ছি না, ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন কমলে রপ্তানিতেও আমরা পিছিয়ে পড়বো, তখন মার্কিন বাজারে বাড়তি শুল্ক হার নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ— রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ— গঠনের সরকারি ঘোষণার পর গত ১৪ মে থেকে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করেন। তারা দাবি করছেন, এই পুনর্গঠনের ফলে এনবিআরের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা হুমকির মুখে পড়বে। ২০ মে একদিনের জন্য আলোচনার আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও ২১ মে থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি আবার শুরু হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখা হয়েছে, বাকি সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে গড়ে ১০ হাজারের বেশি আমদানি ও রপ্তানি নথি দাখিল হয়। কিন্তু এখন আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও শুল্কায়নের অনুমোদন পাচ্ছি না। এতে শুধু আমদানি পণ্য আটকে যাচ্ছে না, শিল্প উৎপাদনেও বড় ধরনের ধাক্কা লাগছে।
এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এই অচলাবস্থা নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আলোচনার আহ্বান থাকলেও কবে নাগাদ সমস্যার সমাধান হবে, তা অনিশ্চিত। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, তারা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবেই এই কর্মবিরতি পালন করছেন এবং বিষয়টি নিয়ে তারা স্বনামে কথা বলতে রাজি নন।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম বন্দরে আর কোনো কনটেইনার রাখার জায়গা থাকবে না—এমন সতর্কতা উচ্চারণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্রবিন্দুতে এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে তা শুধু রপ্তানি আয় নয়, দেশের শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পিপলসনিউজ/আরইউ
-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
ads@peoplenewsbd.com